জাতীয়করণের দাবিতে এমপিওভুক্ত (মাসিক বেতন ভাতাদি প্রাপ্তি) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) এক বিশাল অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের ব্যানারে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ১০ দফা দাবি তুলে ধরা হয়।
শিক্ষক নেতারা তাদের বক্তব্যে বলেন, বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষকদের সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা এখন সময়ের দাবি। এর ফলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি স্থিতিশীল ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
শিক্ষক নেতারা আরও উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে ব্যাপক বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা অনেক কম। জাতীয়করণের মাধ্যমে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে। তারা বলেন, “বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমাদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। জাতীয়করণ হলে শিক্ষকরা আরও উৎসাহিত হয়ে শিক্ষাদানের মান উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে পারবেন।”
এদিকে, গত ২ সেপ্টেম্বর শিক্ষক নেতাদের ১০ জনের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষামন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি-দাওয়ার একটি লিখিত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। শিক্ষামন্ত্রী আন্তরিকতার সাথে বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে আশ্বাস দিলেও, এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে শিক্ষকেরা হতাশাগ্রস্ত এবং ক্ষুব্ধ।
শিক্ষকদের ৯ দফা দাবি
১. শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদান: জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুসারে শতভাগ উৎসব ভাতা, বাড়ি ভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের বেতন গ্রেডে বৈষম্য দূর করতে হবে।
২. জোরপূর্বক পদত্যাগ বন্ধ: কিছু প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর চেষ্টা করছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। শিক্ষকেরা এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
৩. বেতন গ্রেড উন্নীতকরণ: সহকারী শিক্ষকদের প্রারম্ভিক বেতন গ্রেড দশম গ্রেডে উন্নীত করা, সহকারী প্রধান শিক্ষকদের বেতন সপ্তম গ্রেডে উন্নীত করা, এবং প্রধান শিক্ষকদের বেতন ষষ্ঠ গ্রেডে উন্নীত করার দাবি জানানো হয়েছে। এছাড়াও চাকরির সময় দুটি উচ্চতর গ্রেড প্রদান করতে হবে।
৪. সর্বজনীন বদলির ব্যবস্থা: বদলির ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য না রেখে সর্বজনীন বদলির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।
৫. মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষকদের উন্নয়ন: মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষকদের জন্য যুগোপযোগী সংস্কার এবং কামিল মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীত করা। স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা এবং শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির আওতায় আনতে হবে।
৬. কলেজ শিক্ষকদের পদ উন্নীতকরণ: অনুপাত প্রথা বাতিল করে জ্যেষ্ঠ প্রভাষকদের সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত করা এবং ডিগ্রি ও অনার্স কলেজের তৃতীয় শিক্ষকের এমপিওভুক্তি করা।
৭. সকল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ: স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে।
৮. কর্মচারীদের পদোন্নতি: উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা কর্মচারীদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রশাসনে: এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরকে শিক্ষা প্রশাসনে আনুপাতিক হারে পদায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
এই অবস্থান কর্মসূচি ছিল শিক্ষকদের আন্দোলনের অংশ। বিভিন্ন সময়ে নানা দাবি নিয়ে তারা আন্দোলন করেছেন, কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি দীর্ঘদিনের। জাতীয়করণের ফলে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। তারা বৈষম্যহীনভাবে উৎসব ভাতা, বেতন বৃদ্ধি, পেনশন এবং অন্যান্য সুবিধা পাবেন।
কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষক-কর্মচারীরা জানান, “জাতীয়করণ কেবল আমাদের আর্থিক সুরক্ষাই নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতেও বড় ভূমিকা রাখবে।”
শিক্ষক নেতারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদি আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার তাদের দাবি পূরণে পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তারা লাগাতার কর্মবিরতি পালন করবেন। এই কর্মসূচির মধ্যে থাকবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন এবং লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি।
শিক্ষা খাতে বৈষম্য দূর করতে এবং শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণ অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকদের ৯ দফা দাবি, বিশেষ করে জাতীয়করণ, শিক্ষাক্ষেত্রে সমতা এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি এই দাবি মেনে নেয়, তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তন আসবে।