গাজীপুরের টঙ্গী ও তার আশপাশের এলাকাগুলোয় টঙ্গীর ডন মতি চাচা নামে পরিচিত মতিউর রহমান মতি দীর্ঘদিন ধরে অপরাধ ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। কোটি টাকার ঝুট ব্যবসা, মাদক সাম্রাজ্য, দখলবাণিজ্য থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় নিয়োগ বাণিজ্য—সবকিছুতেই মতি চাচার নাম জড়িয়ে আছে। তাঁর অপরাধের চক্র স্থানীয় জনগণ থেকে শুরু করে পুরো দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাম্প্রতিককালে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও গাজীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা হিসেবে মতি চাচার অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, যা ক্ষমতা, প্রভাব ও অর্থের মাধ্যমে টঙ্গীসহ আশপাশের অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করেছে।
অপরাধ সাম্রাজ্যের উত্থান
মতির উত্থানের শুরু ২০০৪ সালে, যখন গাজীপুর-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মামলার বাদী হয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন মতি। পরবর্তীতে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের অধীনে তিনি তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। ভাতিজা জাহিদ আহসান রাসেলও টঙ্গীতে তাঁর ক্ষমতা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৮ সাল থেকে মতি টঙ্গী শিল্পনগরীর ঝুট ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মাদক সাম্রাজ্য এবং দখলদারিতে নেতৃত্ব দেন।
শতকোটি টাকার ঝুট ব্যবসা
টঙ্গীর ঝুট ব্যবসায় মতির প্রভাব অগাধ। তিনি শতকোটি টাকার এই শিল্পকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। প্রতি মাসে ঝুট থেকে তাঁর আয় ছিল ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। শিল্পনগরীর নানা অংশে দখল করে গুদাম তৈরি এবং সেগুলো ভাড়া দিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা আয় করেছেন। টঙ্গীর খাঁপাড়া এলাকা, ব্যাংকের মাঠসহ সরকারি জমি দখল করে গড়ে তোলা এসব গুদাম ও বস্তি থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন তিনি।
চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য
মতির অপরাধের আরেকটি বড় ক্ষেত্র ছিল চাঁদাবাজি ও দখলদারি। টঙ্গীর ফুটপাত থেকে শুরু করে সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, এমনকি ট্রাকস্ট্যান্ড থেকেও চাঁদা তুলতেন। বিভিন্ন সরকারি খাস জমি দখল করে সেখানে গুদাম তৈরি করে ভাড়া দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। টঙ্গীর নতুনবাজারের ক্যাপরি সিনেমা হল দখল করে তিনি প্রথম দখলদারির চক্রে প্রবেশ করেন। মেঘনা টেক্সটাইল মিলসহ বিভিন্ন এলাকার জমি দখল করে কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করেছেন।
মাদক সাম্রাজ্য ও কিশোর গ্যাং
মতির অপরাধ সাম্রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল মাদক ব্যবসা। টঙ্গী ও গাজীপুর এলাকায় মাদক সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন তিনি। এর সঙ্গে ছিল কিশোর গ্যাং ও ক্যাডার বাহিনী পালনের অভিযোগ। এসব গ্যাং তাঁর নির্দেশে এলাকায় নানা অপরাধমূলক কার্যক্রমে লিপ্ত থাকত। মতির নেতৃত্বে টঙ্গীতে মাদক ব্যবসা এতটাই প্রভাব বিস্তার করে যে সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ে মুখ খোলার সাহসও পেত না।
রাজনৈতিক প্রভাব ও পদ বাণিজ্য
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোতে পদ বাণিজ্য করে মতির প্রভাব ছিল অফুরান। দলীয় পদ দেওয়া এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে মতির নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রবল। বিশেষ করে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের মাধ্যমে তিনি বিপুল অর্থ আদায় করেছেন। এ ছাড়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে প্রভাব বিস্তার করে নিজের লোকদের পদে বসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
সম্পদ ও ব্যবসা সাম্রাজ্য
মতি চাচা অপরাধের মাধ্যমে যে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন তা দিয়ে গড়ে তুলেছেন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানা। রাজধানীর উত্তরায় রয়েছে তাঁর বিশাল বহুতল ভবন, নারায়ণগঞ্জে রোলিং মিল, এবং মালয়েশিয়ায় বাড়ি। এসব সম্পদ ও ব্যবসা থেকে তিনি প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা আয় করতেন। এমনকি তাঁর শ্বশুরবাড়িতেও শত বিঘা জমি কিনেছেন। মতির রোলিং মিলের নাম ‘সাউথ-ইস্ট রি-রোলিং মিল’, যেখানে তিনি চেয়ারম্যান এবং তাঁর স্ত্রী ও ছেলে প্রতিষ্ঠানটির অন্যান্য পদে আছেন।
২০১৮ সালে ভাতিজা জাহিদ আহসান রাসেলের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর কিছুটা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকেন মতি। নতুন বলয়ের প্রভাব এবং বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর সংযোগ কমতে থাকে। তবে, তাঁর দীর্ঘদিনের অপরাধচক্র ও সম্পদ সাম্রাজ্য এখনও আলোচিত। সাম্প্রতিককালে, মতি চাচা ও তাঁর ভাতিজা রাসেল ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ ও অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে জনসম্মুখে ব্যাপকভাবে সমালোচিত।