বর্তমান যুগে ডায়াবেটিস বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাইপ-টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আগে বেশিরভাগ মানুষ ‘প্রি-ডায়াবেটিস’ অবস্থার মধ্যে থাকেন, যেখানে রক্তের শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি, কিন্তু ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক নয়। এই পর্যায়ে সচেতনতা এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে টাইপ-টু ডায়াবেটিসে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব। প্রি-ডায়াবেটিস থাকলে খাদ্যাভ্যাসে কিছু কার্যকর পরিবর্তন আনতে হবে, যা রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখবে।
সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য কিছু সহজলভ্য ও কার্যকর সুপারফুড আমাদের আশেপাশেই পাওয়া যায়। এই খাবারগুলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে এবং প্রি-ডায়াবেটিস থেকে টাইপ-টু ডায়াবেটিসে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করতে সক্ষম। এবার দেখে নেওয়া যাক, প্রি-ডায়াবেটিসে ভুগছেন এমন ব্যক্তিরা প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কোন কোন সুপারফুড অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
১. হলুদ
হলুদ একটি বহুল ব্যবহৃত মসলা, যা অনেক ভেষজ গুণসম্পন্ন। এটি প্রদাহ প্রশমিত করতে এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে সক্ষম, যা প্রি-ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। হলুদের মূল উপাদান কারকিউমিন, যা রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়, যা প্রি-ডায়াবেটিসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হলুদ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করার সেরা উপায় হলো, প্রতিদিন এক গ্লাস দুধে এক চা-চামচ হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে পান করা। তবে বাজারের প্যাকেটজাত হলুদের গুঁড়ার পরিবর্তে ঘরে তৈরি বা অর্গানিক হলুদ ব্যবহার করা ভালো।
২. টমেটো
টমেটো আমাদের সবার কাছে পরিচিত এবং সহজলভ্য একটি সবজি। এতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস, বিশেষত লাইকোপেন, যা ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। টমেটোর গ্লাইসেমিক ইনডেক্সও খুব কম, যার ফলে এটি রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়ায় না। তাই প্রি-ডায়াবেটিস রোগীরা টমেটো তাদের খাদ্যতালিকায় নির্দ্বিধায় রাখতে পারেন।
তাজা ও কাঁচা টমেটো খেলে এর সর্বোচ্চ পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়। সালাদে, স্যান্ডউইচে, অথবা রান্নায় টমেটো ব্যবহার করলে এটি রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে।
৩. বাদাম
বাদাম একটি অসাধারণ সুপারফুড, যা প্রি-ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। বাদাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ, যা হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি গ্লাইসেমিক ইনডেক্সেও কম, যা রক্তের শর্করা দ্রুত বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। এছাড়া বাদামে রয়েছে প্রচুর ফাইবার এবং প্রোটিন, যা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে কর্মক্ষম রাখে।
প্রতিদিন এক মুঠো মিশ্র বাদাম যেমন চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, কাজুবাদাম খেলে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাদাম খাওয়ার ফলে ক্ষুধা কম অনুভূত হয়, ফলে অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকসের দিকে ঝোঁকার প্রবণতাও কমে।
৪. করলা
করলা, যদিও তেতো স্বাদের কারণে অনেকের অপছন্দ, এটি একটি অত্যন্ত কার্যকরী সবজি যা প্রি-ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস উভয় অবস্থায়ই সহায়ক। করলায় পলিপেপটাইড-পি নামক একটি প্রাকৃতিক ইনসুলিনের মতো যৌগ রয়েছে, যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত করলা খেলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব এবং এটি টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়।
করলা রান্না করে খাওয়া যেতে পারে, কিংবা এর জুসও তৈরি করা যেতে পারে। প্রতিদিন সকালে করলার জুস পান করা প্রি-ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী হতে পারে।
৫. উদ্ভিজ্জ বীজ
শিমজাতীয় খাবার যেমন মটর, কিডনি বিনস, চনা, মসুর ডাল ইত্যাদি ফাইবারের একটি দুর্দান্ত উৎস। এই খাবারগুলো হজম হতে দীর্ঘ সময় নেয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধির ঝুঁকি কমায়। ফাইবারসমৃদ্ধ হওয়ার কারণে এগুলো খেলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে, ফলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং ব্লাড সুগারও স্থিতিশীল থাকে।
প্রি-ডায়াবেটিস রোগীরা নিয়মিত তাদের খাদ্যতালিকায় শিমজাতীয় খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এটি রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাবে।
প্রি-ডায়াবেটিস থাকা মানে হচ্ছে, আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা প্রাক-ডায়াবেটিসের দিকে ধাবিত হয়েছে, কিন্তু এখনো আপনার সামনে সুযোগ রয়েছে টাইপ-টু ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার। সঠিক সময়ে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনলে এবং সুষম পুষ্টিকর খাবার বেছে নিলে এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। উপরোক্ত সুপারফুডগুলো রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে এবং প্রি-ডায়াবেটিস থেকে টাইপ-টু ডায়াবেটিসে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে হ্রাস করতে পারে।
প্রথমত, প্রক্রিয়াজাত এবং উচ্চ চিনি ও ফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। প্রাকৃতিক, অপ্রক্রিয়াজাত এবং ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং ছোট ছোট অংশে খাবার গ্রহণ করা রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক হবে।
পানি বেশি করে পান করতে হবে, কারণ পানি শরীরে শর্করার ভারসাম্য রক্ষা করে। এছাড়া নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
প্রি-ডায়াবেটিস একটি সতর্কবার্তা যা জানিয়ে দেয় যে আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। সঠিক সময়ে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনলে এবং সুপারফুডগুলো খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করলে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। হলুদ, টমেটো, বাদাম, করলা, এবং শিমজাতীয় খাবার এই প্রি-ডায়াবেটিক অবস্থার বিরুদ্ধে কার্যকরী সুরক্ষা প্রদান করতে পারে।