রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘটিত ডাকাতির ঘটনায় জড়িত আটজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ডাকাতির শিকার এক পরিবারের কাছ থেকে প্রায় সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুটে নেয় এই সংঘবদ্ধ দল।
রবিবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পাঁচ জন দেশের বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত সদস্য। বাকি তিন জন সাধারণ নাগরিক। ডাকাতদের কাছ থেকে সোনার একটি ব্রেসলেট ও একটি আংটি উদ্ধার করা হয়েছে।
ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে র্যাব কর্মকর্তারা জানান, শুক্রবার (১১ অক্টোবর) দিনগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তা মোড়ের কাছে একটি বাড়িতে এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাত দলটি সেনা ও র্যাবের পোশাক পরে, মুখে মাস্ক লাগিয়ে গভীর রাতে বাড়িতে প্রবেশ করে।
ডাকাতি সংঘটিত বাড়ির মালিক আবু বকর জানান, রাতের নিরবতা ভেঙে যখন দরজায় কড়া নাড়া শোনা যায়, তখন বাড়ির দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। তার ভাষ্যমতে, সেনা ও র্যাবের পোশাক পরা দলটি এমনভাবে উপস্থিত ছিল যে, তাদেরকে দেখে দারোয়ান মনে করেন তারা বৈধ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। দারোয়ান সন্দেহ না করেই দরজা খুলে দেয়, এবং তারা দ্রুতই আবু বকরের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে চলে যায়।
আবু বকর আরও বলেন, ‘‘তারা বাসায় ঢুকে আমাকে জানায়, আমি নাকি বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেইনি, আর তাই তারা অস্ত্র নিতে এসেছে। আমি তাদের বলি, আমার বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেওয়া আছে, কিন্তু তারা কোনো কথাই শোনেনি। এরপর তারা আমার আলমারিগুলো খুঁজে তছনছ করে, এবং সেখানে থাকা নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে নেয়। শুধু তাই নয়, তারা ফ্ল্যাটের পাশেই আমার অফিসে গিয়েও একইভাবে সিন্দুক ও আলমারি খুলে টাকা লুট করে।’’
আবু বকরের ভাষ্যমতে, দলটি প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বাড়িতে অবস্থান করে। পরে ভোর সোয়া ৪টার দিকে তারা নির্বিঘ্নে বাড়ি থেকে চলে যায়।
ডাকাতির ঘটনার পরপরই পুলিশ এবং র্যাবের যৌথ তদন্তে নেমে আসে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এবং প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ দ্রুতই ডাকাত চক্রের অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। রবিবার গ্রেফতারকৃতদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়।
র্যাবের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানান, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচ জন আগে দেশের বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, তবে কোনো অপরাধের কারণে তারা চাকরি হারান। এছাড়া, এই চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
পুলিশের তদন্তে আরও জানা গেছে, এই ডাকাতির ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত ছিল। সেনা ও র্যাবের পোশাক পরে ডাকাতি চালানোর মাধ্যমে তারা নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে সহজে প্রতারণা করতে সক্ষম হয়। এই চক্রটির প্রধান পরিকল্পনাকারীরা তাদের বাহিনীর চাকরি হারানোর পর থেকেই অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা আরও বলেন, ডাকাতরা ঘটনাস্থলে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছে। তারা সময় নিয়ে বাড়ির প্রতিটি আলমারি ও সিন্দুক খুলে সব মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায়। এমনকি বাড়ির বিভিন্ন অংশে লুকানো টাকা এবং স্বর্ণালংকারও তারা খুঁজে বের করেছে।
আবু বকর এবং তার পরিবার এই ঘটনার পর চরম মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। এমন একটি ঘটনা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত করে তুলেছে। আবু বকর বলেন, ‘‘আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না যে, আমার বাড়িতে এমনভাবে ঢুকে ডাকাতি হতে পারে। সেনা ও র্যাবের পোশাক পরে আসা লোকজনের ওপর সন্দেহ করার কোনো কারণই ছিল না, কিন্তু সেই সুযোগটাই তারা কাজে লাগিয়েছে।’’
তার পরিবার বর্তমানে পুলিশের নিরাপত্তায় রয়েছে। আবু বকর আরও জানান, তার বৈধ অস্ত্র থানায় জমা ছিল, তবুও ডাকাতরা তাদের মতো করে নিজেদের পরিচয় দিয়ে সব কিছু লুট করেছে।
এই ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব উভয়েই সাধারণ জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক ব্যবহার করে যাতে প্রতারণা করতে না পারে, সে বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে কারও পোশাক বা পরিচয়ের ভিত্তিতে বিশ্বাস স্থাপন না করে নিকটস্থ থানায় বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলা হয়েছে।
র্যাবের পরিচালক মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘‘এই ধরনের অপরাধ আমাদের জন্য নতুন নয়। তবে আমরা অপরাধীদের গ্রেফতারে এবং তাদের চক্রের মূল পরিকল্পনাকারীদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। জনগণকে অনুরোধ করছি, তারা যেন অচেনা বা সন্দেহজনক ব্যক্তির ব্যাপারে সতর্ক থাকেন এবং পুলিশকে জানান।’’
এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন আরও কঠোর নজরদারি চালানোর পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে গভীর রাতে চলাচলকারী এবং সেনা বা র্যাবের পোশাক পরা ব্যক্তিদের উপর কড়া নজরদারি চালানো হবে। অপরাধীরা যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে সুবিধা নিতে না পারে, সে জন্য বাহিনীর পোশাক ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হবে।
মোহাম্মদপুরের এই সংঘবদ্ধ ডাকাতির ঘটনা রাজধানীতে নিরাপত্তার একটি বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছে। সাধারণ মানুষের জন্য এমন ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হওয়ায় কিছুটা হলেও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব আরও জোরদার করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।