বঙ্গোপসাগরে সাগর উপকূল থেকে মিয়ানমারের নৌবাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যাওয়া ৬টি ফিশিং ট্রলারের ৫টি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেশে ফিরে এসেছে। এর মধ্যে ৪৭ জন মাঝিমাল্লা ও জেলে রয়েছে বলে জানিয়েছে কোস্টগার্ড। এর আগে, দুপুরে ১টি ট্রলার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেখানে ছিল ১১ জন জেলে, যাদের একজন মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে নিহত হন এবং দুজন আহত অবস্থায় ছিলেন। সবমিলিয়ে ৫৮ মাঝিমাল্লাসহ ৬টি ট্রলার দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে পুরো ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে প্রায় ১৫ নটিক্যাল মাইল দূরে বাংলাদেশের জলসীমায় মিয়ানমারের নৌবাহিনী হঠাৎ করে আক্রমণ চালায়। তারা ৬টি ফিশিং ট্রলার ধরে নিয়ে যায় এবং জেলেদের উপর গুলিবর্ষণ করে। শাহপরীর দ্বীপের জেলে মো. ওসমান গনি (৪০), যিনি সাইফুল কোম্পানির একটি ট্রলারে কাজ করতেন, এই গুলিতে নিহত হন। এছাড়াও একই ট্রলারের দুই জেলে গুরুতরভাবে আহত হন।
মিয়ানমারের নৌবাহিনী ট্রলারগুলিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর, তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর নজরে আসে। বৃহস্পতিবার সকাল ও বিকালে মিয়ানমারের নৌবাহিনী ৬টি ট্রলার ও তাতে থাকা মাঝিমাল্লাদের ফেরত দেয়। প্রথমে দুপুরে একটি ট্রলার ফেরত আসে, যেখানে ছিল ১১ জন জেলে, তার মধ্যে নিহত মো. ওসমান গনির মরদেহ এবং আহত দুইজন। বিকালে আরও ৫টি ট্রলার মাঝিমাল্লাসহ সেন্টমার্টিনে আসে, যেখান থেকে কোস্টগার্ড তাদের শাহপরীর দ্বীপে ফিরিয়ে আনে।
ফিরে আসা জেলেদের অভিজ্ঞতা ছিল আতঙ্কজনক। তারা জানায়, মিয়ানমারের নৌবাহিনী কোনো সতর্কতা ছাড়াই তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে এবং জোর করে তাদের ধরে নিয়ে যায়। শাহপরীর দ্বীপের জেলে সাইফুল বলেন, “আমরা সাধারণত মাছ ধরতে যাই, কিন্তু মিয়ানমারের নৌবাহিনী হঠাৎ আমাদের ওপর গুলি চালায়। আমরা তাদের কাছ থেকে পালাতে পারিনি।”
নিহত জেলে মো. ওসমান গনি ছিলেন শাহপরীর দ্বীপের কোনারপাড়া এলাকার বাসিন্দা এবং বাচ্চু মিয়ার ছেলে। আহত দুইজন একই ট্রলারের জেলে। তারা বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এবং তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। শাহপরীর দ্বীপের জেলে সমাজ এই মৃত্যুকে গভীরভাবে শোকাহত করেছে এবং এর সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
ধরে নিয়ে যাওয়া ট্রলারগুলোর মধ্যে ছিল শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রীপাড়ার মুসলিম মিয়ার ছেলে মতিউর রহমানের ২টি, মৃত আলী হোছনের ছেলে আবদুল্লাহ ও তার ভাই আতা উল্লাহর ১টি, এবং উত্তরপাড়ার ছৈয়দ মাঝির ছেলে মো. আছেমের ১টি ট্রলার। ট্রলার মালিক মতিউর রহমান বলেন, “আমার ট্রলারের সব জেলেরা ফিরে এসেছে। তবে এই ঘটনা খুবই ভয়াবহ ছিল। সাগরে মাছ ধরার সময় এ ধরনের আক্রমণ খুবই অমানবিক। আমরা চাই এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।”
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী জানান, “বাংলাদেশের জলসীমায় মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলি চালানোর ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখছি এবং উভয় দেশের কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সমাধানের জন্য আলোচনা চলছে।” তিনি আরও বলেন, “কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনী এই ঘটনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।”
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সাম্প্রতিক উত্তেজনা এই ঘটনার মাধ্যমে আরও স্পষ্ট হয়েছে। এর আগেও মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীরা বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে গিয়েছে, তবে এমন সরাসরি গুলির ঘটনা খুবই কম। ঘটনার পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের নৌবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়, যার ফলস্বরূপ জেলেদের ও ট্রলারগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে এই ঘটনার পরে বাংলাদেশের সরকার কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়।
এ ঘটনাকে ঘিরে স্থানীয় জেলে ও মাছ ধরা ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। তারা সরকারের কাছে নিরাপত্তা বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে। কোস্টগার্ডও বলেছে যে তারা বঙ্গোপসাগরের সীমান্ত এলাকায় টহল জোরদার করবে, যাতে ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধ করা যায়।
সরকারি মহল থেকেও বলা হয়েছে যে, সাগরে মাছ ধরার সময় জেলেদের আরও সতর্ক থাকতে হবে এবং সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় মাছ ধরা থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি, দুই দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে যে অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, তা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে একজন বাংলাদেশি জেলে নিহত হওয়া এবং আরও দুইজন আহত হওয়া এই ঘটনাটি নতুন করে সীমান্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং জেলেদের সুরক্ষায় আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জোর দিচ্ছে।