সাদা কাপড়ে মোড়ানো এক নারীর অসহায় কান্না ঘরের নিস্তব্ধতাকে আরও ভারী করে তুলছে। দরজায় বসে আছে তার তিন সন্তান—পিতৃহারা বেদনায় নির্বাক। তাদের বাবা কামাল হোসেন আর কখনো ঘরে ফিরবেন না। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত হওয়া কামালের মৃত্যু যেন এক পরিবারকে ভেঙে দিয়েছে। কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার জোলাই কুড়িয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা কামাল তার পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিলেন। তার মৃত্যু শুধু একটি পরিবার নয়, একটি সম্প্রদায়ের ন্যায়বিচারের প্রশ্নও সামনে এনেছে।
৭ অক্টোবর, সোমবার সন্ধ্যায় কুমিল্লার পাহাড়পুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে নিহত হন কামাল। ঘটনার পর বিএসএফ তার মরদেহ নিয়ে যায় এবং ২৭ ঘণ্টা পর ৮ অক্টোবর রাতে তা ফেরত দেয়। নিহত কামাল হোসেন পিঁপড়ার বাসা ভেঙে ডিম বিক্রি করতেন এবং সীমান্ত এলাকায় এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তবে সেদিন তাকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অন্য এক পরিস্থিতিতে।
কামালের স্ত্রী জোহরা বেগমের বর্ণনা অনুযায়ী, তার স্বামী ঘরে অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু ‘লাদেন কামাল’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তি জোর করে তাকে সীমান্তে নিয়ে যায়। কামাল প্রথমে না যেতে চাইলে, লাদেন তাকে হুমকি দেন যে না গেলে তার নামে মামলা করা হবে। বাধ্য হয়ে কামাল তার সঙ্গী হিসেবে যেতে রাজি হন। এরপর সীমান্তে গিয়ে ঘটে যায় সেই ভয়াবহ ঘটনা। বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালে কামাল ঘটনাস্থলেই নিহত হন। তার সঙ্গে থাকা বাকি দুজন পালিয়ে ফিরে আসতে পারলেও, কামাল আর ফিরে আসেননি।
কামালের পরিবারের প্রশ্ন একটাই: অপরাধ করলেও আইন রয়েছে, তবে গুলি করে হত্যা করার প্রয়োজন কেন? কামালের স্ত্রী জোহরা বেগম এক অসহায় ভঙ্গিতে বলেন, “আমার স্বামী যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাকে গ্রেফতার করা যেতো। এমনকি পিটিয়েও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যেতো। এতে এক যুগ পর হলেও সন্তানরা তাদের বাবাকে পেতো, আমি স্বামীহারা হতাম না। কিন্তু গুলি করে মেরে ফেললো, বিচার কোথায়?”
কামালের মেয়ে কামরুন নাহার জাহান শান্তাও একই প্রশ্ন তুলে বলেন, “আমার বাবাকে জোর করে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের বাড়ির কাছে সীমান্ত থাকলেও কেন তাকে এত দূরে নিয়ে গেল? আমার বাবা যদি কোনো অপরাধ করেও থাকে, আইন অনুযায়ী তার বিচার হওয়া উচিত ছিল।”
কামালের প্রতিবেশী মন্তাজ মিয়ার মতে, লাদেন কামালসহ আরও দুইজনকে জোর করে সীমান্তে নিয়ে যান। বিএসএফের গুলির পর কামাল মারা যান, বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মন্তাজ মিয়ার বক্তব্য স্থানীয়দের অভিযোগের সাথে মিলে যায়, যারা বলছেন যে সীমান্তের অপরাধমূলক কার্যকলাপে লোকজনকে জোর করে নিয়োজিত করা হয়।
১০ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইফতেখার হোসেন জানান, “কামালের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, এবং আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।” তবে সাধারণ জনগণের বিশ্বাসের সংকট এখানে দৃশ্যমান। সীমান্ত এলাকায় গুলিতে হত্যা দীর্ঘদিন ধরেই একটি সংকটপূর্ণ ইস্যু। যদিও বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে, তবু ন্যায়বিচার আদায় কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
সীমান্তে গুলি করে হত্যা শুধু একটি প্রাণের ক্ষতি নয়, বরং এটি একেকটি পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। কামালের পরিবার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তার মৃত্যুতে তিন শিশু সন্তান এবং স্ত্রী এখন অসহায়। পরিবারের আর্থিক অবস্থা এমনিতেই দুর্বল ছিল, তার উপর কামালের মৃত্যুতে তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এমন ঘটনাগুলো প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে আসে। তবে ন্যায়বিচারের অভাব এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করার অভিযোগ থাকলেও, এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায় না। সীমান্তের বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত এই ভয়ের মধ্যে বেঁচে থাকেন। এমনকি নানান অপরাধের শিকারও হন।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে চোরাচালান, মানবপাচার এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যকলাপ নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে সীমান্তে কাজ করতে যাওয়া মানুষজনকে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ২০২৪ সালের কামাল হোসেনের হত্যাকাণ্ড সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
সীমান্তের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সাধারণত স্থানীয় অপরাধীরা জড়িত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নির্দোষ মানুষকেও সীমান্ত পেরিয়ে অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেলা হয়। বিএসএফের তরফ থেকে সীমান্ত সুরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে মানুষকে গুলি করা হলেও, সেখানে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরে বিবেচনায় আসছে। কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সীমান্তে মানুষ হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গুরুতর ইস্যু। আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি চালানোর আগে আইনসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা বা বিচার করা যায়, কিন্তু সরাসরি গুলি করে হত্যা করা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষত যখন ভুক্তভোগী ব্যক্তি অপরাধী প্রমাণিতও হননি।
কামালের পরিবারের মতো আরও বহু পরিবার বিচারহীনতার শিকার হয়ে সীমান্তে প্রাণ হারিয়েছে। তাদের দাবিও একই: অপরাধ করলে আইনানুগ বিচার হোক, কিন্তু গুলি করে হত্যা কেন? প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর সীমান্তে ন্যায়বিচার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে আওয়াজ উঠলেও, দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি।
কামাল হোসেনের মৃত্যু শুধু তার পরিবারকে ভেঙে দেয়নি, বরং সীমান্তের ন্যায়বিচারের প্রশ্নকেও সামনে এনেছে। অপরাধের শাস্তি হিসেবে গুলি করে হত্যা নয়, বরং আইনানুগ বিচারই হওয়া উচিত। কামালের স্ত্রী ও সন্তানেরা এখন শুধু ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছেন। তাদের প্রশ্ন, “অপরাধ করলে আইন আছে, গুলি করে মারা হবে কেন?” এই প্রশ্নের উত্তর শুধু কামালের পরিবার নয়, বরং পুরো সমাজও খুঁজছে।