রসায়নের জগতে নোবেল পুরস্কার বরাবরই বিজ্ঞানীদের জন্য একটি অনন্য সম্মান ও স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত। ২০২৪ সালে রসায়নে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন তিনজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী: ডেভিড বেকার, ডেমিস হ্যাসাবিস এবং জন এম. জাম্পার। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস এই ঘোষণা দেয়।
এবারের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে বায়োকেমিস্ট্রি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ভিত্তিক গবেষণায় তাদের অবদানের জন্য। ডেভিড বেকারকে “কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইনের জন্য” পুরস্কারের অর্ধেক এবং “প্রোটিন গঠনের পূর্বাভাস” দিতে সক্ষম মডেল তৈরি করার জন্য বাকি অর্ধেক পুরস্কার যৌথভাবে ডেমিস হ্যাসাবিস ও জন এম. জাম্পারকে দেওয়া হয়। এই গবেষণা নতুন ওষুধ আবিষ্কার থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় কার্যকর হবে বলে নোবেল কমিটি আশা করছে।
ডেভিড বেকার কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইন পদ্ধতি তৈরি করে এক অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। তার গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এমন প্রোটিন তৈরি করা, যা প্রকৃতিতে আগে কখনো দেখা যায়নি। প্রোটিন হলো জীবের প্রধান কাজের চালক এবং এর গঠনই নির্ধারণ করে এটি কিভাবে কাজ করবে। প্রোটিনের গঠন কৃত্রিমভাবে ডিজাইন করার মাধ্যমে নতুন প্রোটিন তৈরি সম্ভব হয়েছে, যা নতুন ওষুধ এবং চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।
বেকারের কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সহজে নতুন প্রোটিন তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছেন। এই প্রোটিনের ব্যবহার বায়োমেডিক্যাল গবেষণায় বিপ্লব ঘটাচ্ছে, যা থেকে ভবিষ্যতে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক ও চিকিৎসা উদ্ভাবিত হবে বলে আশাবাদী গবেষকরা।
প্রোটিনের গঠন পূর্বানুমান করা একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া, যা বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। ডেমিস হ্যাসাবিস ও জন এম. জাম্পার নেতৃত্বাধীন গবেষণাগারে তৈরি “আলফাফোল্ড” নামে একটি AI মডেল এই সমস্যার সমাধান দিয়েছে। এই মডেলটি প্রোটিনের গঠন খুবই সঠিকভাবে পূর্বানুমান করতে সক্ষম, যা বায়োলজিক্যাল বিজ্ঞানকে এক নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিয়েছে।
আলফাফোল্ড প্রোটিনের গঠন সম্পর্কে তথ্য দিয়ে জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা ত্বরান্বিত করেছে। এটি মূলত প্রোটিনের অ্যামিনো এসিড সিকোয়েন্সের ভিত্তিতে তার গঠন নির্ধারণ করতে পারে, যা আগে খুবই সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল ছিল। এই প্রক্রিয়া এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অতি দ্রুত এবং সঠিকভাবে করা সম্ভব হচ্ছে।
রসায়নে নোবেল পুরস্কার প্রথম দেওয়া হয় ১৯০১ সালে। তখন এই পুরস্কার পান জ্যাকবাস এইচ. ভ্যান হফ। ১৯০১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১৮টি নোবেল পুরস্কার রসায়নে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার ও ব্যারি শার্পলেস দুইবার করে এই পুরস্কার পেয়েছেন। এরকম ঘটনা ইতিহাসে খুবই বিরল।
রসায়নের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন ফ্রেডেরিক জোলিয়ট। ১৯৩৫ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। অন্যদিকে, সবচেয়ে বেশি বয়সে নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী হলেন জন বি. গুডএনাফ, যিনি ৯৭ বছর বয়সে এই পুরস্কার অর্জন করেন।
এখন পর্যন্ত রসায়নে ২৭টি নোবেল পুরস্কার যৌথভাবে তিনজন বিজ্ঞানী পেয়েছেন, যা এবারও পুনরাবৃত্তি হয়েছে। রসায়নে নোবেল বিজয়ী নারীদের সংখ্যা ৮ জন। এই সংখ্যা এখনও বিজ্ঞান জগতে লিঙ্গ বৈষম্যের একটি প্রমাণ হিসাবে দেখা হয়, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।
রসায়নের মতো চিকিৎসাশাস্ত্র ও পদার্থবিজ্ঞানেও নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে ২০২৪ সালে। ৭ অক্টোবর, ২০২৪ তারিখে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকান। তাদের গবেষণা “মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার এবং পোস্ট-ট্রান্সক্রিপশনাল জিন নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা” নিয়ে।
অন্যদিকে, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জন জে. হপফিল্ড ও জিওফ্রে ই. হিন্টন। তাদের গবেষণা কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক এবং মেশিন লার্নিংয়ের উপর ভিত্তি করে। তারা মেশিন লার্নিংয়ের দক্ষতা বাড়াতে যুগান্তকারী অবদান রেখেছেন, যা AI এবং স্বচালিত প্রযুক্তির বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
নোবেল পুরস্কার প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রদান করা হয়। বিজয়ীরা এই দিনে একটি স্বর্ণপদক, প্রশংসাপত্র, এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পুরস্কার হিসেবে পান। বর্তমানে, প্রতিটি বিভাগে ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা (প্রায় ১ মিলিয়ন ইউএস ডলার) পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়।
আলফ্রেড নোবেল, যিনি ডিনামাইটের উদ্ভাবক, ১৮৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী এবং রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থের দ্বারা এই পুরস্কারের সূচনা হয়। নোবেল পুরস্কার এখন বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসাবে পরিগণিত হয়, যা বিভিন্ন শাখায় বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ ও মানবতার উন্নয়নের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদান করা হয়।
২০২৪ সালের রসায়নে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তিন বিজ্ঞানীর গবেষণা আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিগন্তকে আরও প্রসারিত করেছে। প্রোটিন ডিজাইন ও প্রোটিন গঠনের পূর্বাভাসে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর গবেষণা ভবিষ্যতে নতুন আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করবে। এই অর্জন শুধু রসায়নের জন্য নয়, বরং জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জন্যও এক বিশাল অর্জন।