মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লেবানন এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ থেকে লাগাতার হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে ইরাকের ইসলামিক প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চল এবং অধিকৃত গোলান মালভূমিতে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এমনটাই জানিয়েছে আলজাজিরার এক প্রতিবেদন।
ইরাকের ইসলামিক প্রতিরোধ যোদ্ধারা দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলোর পাশাপাশি অধিকৃত গোলান মালভূমিতে তিনটি ড্রোন হামলা চালিয়েছে। যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে এই হামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে এই হামলা ইসরায়েল-লেবাননের মধ্যকার চলমান সংঘাতকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লেবাননের প্রতিরোধ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ সম্প্রতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বৃষ্টির মতো রকেট ছুঁড়েছে। আনাদোলু এজেন্সির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সোমবার ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে একদিনে ১৭৫টিরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১২ জানায়, এসব রকেট হামলা ইসরায়েলের নাহারিয়া, হাইফা, অ্যাক্রি এবং কেরায়ত অঞ্চলে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। একবারে ৪০টি রকেটের এক বিশাল ব্যারেজ এসব এলাকায় আঘাত হানে। তবে এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসও ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তারা ঘোষণা করেছে যে, যুদ্ধের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তেলআবিবে বেশ কয়েকটি রকেট হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকা থেকে পাঁচটি প্রজেক্টাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত এ ধরনের হামলার প্রতিক্রিয়ায় বড় ধরনের কোনো ঘোষণা দেয়নি। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে এবং গাজার পাশে থাকা সামরিক ঘাঁটিগুলোতে হামলা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। হিজবুল্লাহ এবং হামাস উভয়ের তরফ থেকে অব্যাহত রকেট হামলা, ড্রোন আক্রমণ এবং গোলাগুলি ইসরায়েলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য বর্তমানে সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে অনেক বিপদের মুহূর্ত এসেছে, তবে এই উত্তেজনা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক। বিশেষত, গত সাত দিনের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সশস্ত্র সংঘাত নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যায় ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলায় ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে এবং অনেক আবাসিক ভবন ধসে পড়ে। মাটিতে বড় গর্ত তৈরি হয় এবং পুরো বৈরুত ধোঁয়া ও ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী হিজবুল্লাহর বাংকার লক্ষ্য করে এই হামলা চালায়।
এ ঘটনায় হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন এবং এই খবর মিডিয়ায় আসার পর মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত আরও জটিল হয়ে ওঠে। ইসরায়েলি হামলায় গত এক সপ্তাহে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে নাসরুল্লাহর মৃত্যু এই সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
ইসরায়েল গত এক সপ্তাহ ধরে লেবাননে স্থল অভিযানের মাধ্যমে ব্যাপক আক্রমণ চালাচ্ছে। এর মধ্যে হিজবুল্লাহর ওপর একাধিক বোমা হামলা এবং বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এর আগে, ৩২ জনেরও বেশি সদস্য নিহত এবং প্রায় ৩ হাজার মানুষ আহত হয়েছিল একাধিক ওয়াকি-টকি এবং পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায়।
ইরানও ইসরায়েলের ওপর ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। ইরান প্রায় ২০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে নিক্ষেপ করেছে। তেহরান থেকে পাল্টা হামলার ঘোষণা আসার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলো এই উত্তেজনা কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও দ্রুত সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ এর পক্ষ থেকেও সব পক্ষকে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে। তবে সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান আসেনি এবং সংঘাত ক্রমশ বাড়ছে।
এই অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামরিক উত্তেজনা এবং বহিরাগত শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপে মধ্যপ্রাচ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় বিশ্ব সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সংঘাত দ্রুত সমাধান করা না হয়, তবে এটি বড় ধরনের যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যা পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করবে।
এই সংকট মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রভাবও পড়তে পারে, কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত আন্তর্জাতিক জ্বালানি সরবরাহ এবং বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই সংঘাত শুধু ইসরায়েল, লেবানন এবং ইরানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এতে প্রভাবিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। প্রতিদিনের নতুন নতুন হামলা ও পাল্টা হামলার ফলে সংঘাত ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।