ঢাকার ৬ষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ মোরশেদ আলমের আদালত বুধবার (৯ অক্টোবর) তাসলিমা বেগম রেনু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। আলোচিত এই মামলায় প্রধান আসামি ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড এবং চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা:
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি: ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা: রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ ওরফে আজাদ মন্ডল, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলাম।
প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেনু। তখন স্থানীয় জনতা তাকে ছেলেধরা সন্দেহে বাড্ডা কাঁচাবাজার সড়কে পিটিয়ে হত্যা করে। সকাল পৌনে ৯টার দিকে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
সেই দিন রাতে নিহত রেনুর ভাগিনা সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আব্দুল হক। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। এছাড়া অপ্রাপ্তবয়স্ক দুইজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়, যাদের মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এ বিচারাধীন রয়েছে।
২০২১ সালের ১ এপ্রিল ঢাকার ৬ষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফাতেমা ইমরুজ কনিকা ১৩ জন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। মামলাটিতে মোট ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণের পর আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের তারিখ ধার্য করা হয়।
রায়ের দিন ধার্য ছিল গত ৩০ সেপ্টেম্বর। তবে সেদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় আদালত ৯ অক্টোবর রায়ের নতুন তারিখ নির্ধারণ করেন। অবশেষে বুধবার রায় ঘোষণা করা হয়, যেখানে প্রধান আসামি হৃদয় মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি চার আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ট্র্যাজিক এই ঘটনার পরপরই সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। রেনুর মৃত্যু ছেলেধরা গুজবের নির্মম পরিণতি হিসেবে মানুষের সামনে আসে। আদালতের এই রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রায় সমাজে একটি বার্তা পাঠাবে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই, এবং সুশৃঙ্খল বিচারিক প্রক্রিয়া ছাড়া অপরাধের দায়মুক্তি অসম্ভব।
রায়ে উল্লেখিত আসামিরা হলেন ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লা, রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন, মো. শাহিন, বাচ্চু মিয়া, মো. বাপ্পি ওরফে শহিদুল ইসলাম, মুরাদ মিয়া, সোহেল রানা, আসাদুল ইসলাম, বেল্লাল মোল্লা, মো. রাজু ওরফে রুম্মান হোসেন এবং মহিউদ্দিন।
এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় মোট ১৩ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামির বিরুদ্ধে মামলা পরিচালিত হয়েছে, তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই আসামির মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালে চলমান রয়েছে। এছাড়া সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় আটজনকে আদালত খালাস দিয়েছেন।
তাসলিমা বেগম রেনুর হত্যাকাণ্ড একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা প্রকাশ করে। ছেলেধরা সন্দেহের মতো ভ্রান্ত ধারণার কারণে মানুষকে হত্যার ঘটনা আইনশৃঙ্খলা ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। আদালতের এই রায় থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে সরকারের আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি উঠেছে।