দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের প্রশাসনিক পদে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর এই প্রবণতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেছেন, “একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০, ৪০০, ৫০০ শিক্ষক আছেন। সবাই কেন ভিসি হতে চান, আমি বুঝি না। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে চান না।” এই মন্তব্যে স্পষ্ট যে, শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে ভিসি (উপাচার্য) পদের জন্য, যা তাদের প্রধান দায়িত্ব—অর্থাৎ শিক্ষাদান—থেকে বিচ্ছিন্ন করছে।
আজ রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ড. মাহমুদ এই কথা বলেন। তিনি উল্লেখ করেন, “আমি তো ভিসি হতে চাইনি।” তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের মূল কাজ, অর্থাৎ শিক্ষাদান ও গবেষণার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে প্রশাসনিক কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
উপদেষ্টার এই মন্তব্যের মাধ্যমে এক প্রশ্ন উঠে আসে—কেন এত সংখ্যক শিক্ষক ভিসি হতে চান? ভিসি হিসেবে কাজ করার আকাঙ্ক্ষা একটি প্রাকৃতিক মানসিক প্রবণতা হতে পারে, যা অধিকতর প্রভাবশালী এবং প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা থেকে উৎসারিত হয়। তবে এর পাশাপাশি, ভিসি হওয়ার সাথে নির্দিষ্ট আর্থিক, সামাজিক এবং পেশাগত সুবিধা জড়িত, যা অনেকের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি হওয়ার মাধ্যমে শুধুমাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জনই নয়, শিক্ষকদের পেশাগত ও সামাজিক অবস্থানও পরিবর্তিত হয়। ভিসি হিসেবে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হওয়ার মানসিক ও সামাজিক গৌরব অনেকের কাছে প্রলুব্ধকর। এছাড়া, প্রশাসনিক পদে থাকার কারণে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়, যা শিক্ষকতার তুলনায় আকর্ষণীয় হতে পারে।
ড. মাহমুদের মন্তব্যে এক ধরনের ইঙ্গিত রয়েছে যে, শিক্ষকদের মধ্যে ভিসি হওয়ার এই প্রবণতা শিক্ষার মূল কাঠামোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একজন শিক্ষক যখন প্রশাসনিক পদে অতিরিক্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন, তখন তাঁর মূল কাজ, অর্থাৎ শিক্ষাদান এবং গবেষণা, অবহেলিত হতে থাকে। ফলস্বরূপ, শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি ঘটে এবং শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছ থেকে সঠিক নির্দেশনা ও সময় পায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করা, তাদের মননশীলতা ও চিন্তাশক্তির বিকাশে সহায়তা করা। কিন্তু প্রশাসনিক কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠলে শিক্ষকরা তাদের এই প্রধান দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যান। এতে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকদের ভিসি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি, ড. মাহমুদ দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়েও মন্তব্য করেন। তিনি উল্লেখ করেন, দেশে বর্তমানে বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যাংকের মালিকরা বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। যদিও বেসরকারি খাত দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি, তবে বর্তমানে তাদের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করছে।
ড. মাহমুদ বলেন, এত বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিনিয়োগের এই শ্লথগতি কিছুটা স্বাভাবিক। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং শিল্পায়নের গতি বাড়াতে বিনিয়োগকারীদের পুনরায় সক্রিয় করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল। তাই পরিসংখ্যানের নির্ভুলতা নিয়ে আরও মনোযোগী হতে হবে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, সারা দেশে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের আওতায় কত গাড়ি রয়েছে এবং সেগুলো কী অবস্থায় আছে, তারও হিসাব নেওয়া হবে। তিনি জানান, উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন উপদেষ্টা পরিষদে পেশ করবেন। সরকারি প্রকল্পগুলোতে ব্যবহৃত গাড়ির কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে এবং অপচয় কমাতে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এই ধরনের উদ্যোগ দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সঠিক বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় ও নিরীক্ষার মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি আসবে এবং অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে।
ড. মাহমুদ আরও বলেন, দেশের পরিসংখ্যান বিভাগের সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে কোনো তিরস্কার করেননি, তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিসংখ্যান বিভাগের প্রায় একই অবস্থা বলে উল্লেখ করেন। ভারতের পরিসংখ্যান সংস্থার সক্ষমতা আগে ভালো ছিল, তবে ইদানীং সেখানেও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
পরিসংখ্যান সঠিক না হলে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন যথাযথভাবে করা সম্ভব হয় না। তাই সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের সঠিক চিত্র পেতে পরিসংখ্যান বিভাগকে আরও দক্ষতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের উচ্চশিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে এবং শিক্ষকদের শিক্ষাদানে মনোযোগী করে তোলার জন্য প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব শিক্ষাদান ও গবেষণায় কেন্দ্রীভূত থাকা উচিত। ভিসি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা প্রশাসনিক পদে যাওয়ার মানসিকতা যদি শিক্ষকদের মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে, তবে তা শিক্ষার মানের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মন্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শিক্ষকদের আসল কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়তা করা এবং জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়োজিত রাখা। প্রশাসনিক পদের প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁক শিক্ষার মৌলিক গুণাগুণ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় এমন নীতিমালা থাকা প্রয়োজন, যা শিক্ষকদের মূল দায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে এবং শিক্ষার মান উন্নত করবে।
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মন্তব্য শুধু শিক্ষাবিদদের জন্য নয়, সমাজের জন্যও একটি চিন্তার বিষয়।