বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পঞ্চম বার্ষিকী আজ। পাঁচ বছর পার হলেও আবরারের মা রোকেয়া খাতুনের কাছে এ যেন সেদিনেরই ঘটনা। তাঁর দিনগুলো কেটে যায় ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। “আম্মু খাবার দাও” বা “আম্মু এটা রান্না করো”—এমন কথা যেন এখনও তাঁর কানে বাজে। সেই মায়ের কান্না আজও থামে না। আবরারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তিনি প্রায় ঘরের বাইরেই যান না, ব্যস্ত থাকেন নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও ছেলের স্মৃতিচারণে।
রোকেয়া খাতুনের কাছে প্রতিটি রবিবার আবরারের সঙ্গে শেষ বিদায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবরের সেই দিনটি যখন তিনি রিকশা করে ছেলেকে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন। সকাল সাড়ে ৯টার বাসে আবরারকে বিদায় জানানোর পর রোকেয়া খাতুন জানতেন না, সেটাই হবে তাঁর ছেলের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। তারপরের রবিবারের কথা আর মনে করতে চান না। ঘরের কোনায় কোনায় ছেলের হাসি আর কথাবার্তার স্মৃতিতে আজও ডুবে থাকেন।
আবরারের মা বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে রবিবারে আমার সোনার ছেলে আবরারকে বুয়েটের শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ছাত্রাবাস থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। মধ্যরাতে বুয়েটের ছাত্রাবাসের ২০১১ নং কক্ষে আবরারকে মারধর করা হয় এবং তাঁর মৃত্যু হয়।’ এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর পুরো দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, এবং আবরার হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়।
আবরারের মা জানান, বিচার প্রক্রিয়া কিছুটা এগিয়েছে। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করা হয়, যেখানে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। কিন্তু রোকেয়া খাতুনের মনের শান্তি এখনো আসেনি। কারণ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি এহতেশামুল রাব্বী তানিম, মুজতবা রাফিদ ও মোর্শেদুজ্জামান মণ্ডল জিসান পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেপ্তার না হওয়ায় আবরারের মা এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার বিচার কিছুটা হলেও হয়েছে, তবে পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আমার মনে শান্তি আসবে না। আমি চাই, দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা হোক এবং সব আসামির শাস্তি কার্যকর করা হোক।’
রোকেয়া খাতুনের একমাত্র সম্বল এখন তাঁর ছোট ছেলে আবরার ফায়াজ। আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ প্রয়োজনীয় কাজে মাঝে মাঝে বাইরে থাকেন, আর ছোট ভাই ফায়াজ বর্তমানে বুয়েটে পড়াশোনা করছেন। আবরারের হত্যার পর থেকেই তাঁদের জীবন থেমে গেছে, সময় যেন চলতে চায় না। আবরারের মা বলেন, ‘মামলা করতে প্রথমে ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছিল। পরে আরও ছয়জনের নাম বের হয়, যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বর্তমানে মামলাটি উচ্চ আদালতের ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চে রয়েছে, এবং নিষ্পত্তি হতে সময় লাগবে আরও কিছু বছর।’
এ দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া আবরারের মায়ের জন্য অত্যন্ত কষ্টের। তিনি জানান, ‘আমরা কেবল ন্যায়বিচার চাই। আমি চাই, পলাতক আসামিরা শিগগিরই গ্রেপ্তার হোক এবং আদালতের রায় সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা হোক। আরও যদি কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থেকে থাকে, তাদের মুখোশও উন্মোচিত হোক।’
রোকেয়া খাতুন ছেলের সঙ্গে শেষ দিনের স্মৃতি শেয়ার করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ‘শেষবার ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর সকালে ওকে মাছ-ভাত খাইয়ে বাসে তুলে দিয়েছিলাম। সেদিন সন্ধ্যার আগে হলে পৌঁছে আমাকে ফোন করেছিল। ওর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল, যখন বলেছিলাম, আব্বু, তুমি কাপড় ছেড়ে খাবারগুলো খেয়ে নিও। এই ছিল ছেলের সঙ্গে আমার শেষ কথা।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, ‘ওই দিন মুরগির মাংস আর চালের রুটি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ও খেতে পেরেছিল কি না, জানি না। আমি কেবল সবার কাছে দোয়া চাইছি, আমার ছেলেটার জন্য যেন সবাই দোয়া করেন। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।’
আবরারের মা রোকেয়া খাতুন আরও বলেন, ‘আদালতের রায়ে আসামিদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দেওয়া হলেও, আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। বিশেষ করে আসামি অমিতের ফাঁসি না হওয়ায় আমি মর্মাহত। আমি চাই, যারা প্রকৃতপক্ষে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে, তাদেরও মুখোশ উন্মোচিত হোক।’
এই ঘটনায় পুরো দেশ জুড়ে ছাত্র-জনতার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড আজও অনেকের হৃদয়ে গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে।