পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানের স্পিনওয়াম এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের এক ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনায় ঊর্ধ্বতন এক সেনা কর্মকর্তাসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ আলী শওকত ও আরও পাঁচজন সেনা সদস্য ছাড়াও ছয়জন সন্ত্রাসী রয়েছেন। এই ঘটনাটি পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আরেকটি নির্মম অধ্যায় যোগ করেছে।
পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ দপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, ৫ অক্টোবর শনিবার উত্তর ওয়াজিরিস্তানের স্পিনওয়াম এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনী এবং সন্ত্রাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্ত্রাসীদের উপস্থিতির গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করছিল। অভিযানের সময় সন্ত্রাসীরা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়, যা দ্রুতই ভয়াবহ সংঘর্ষে রূপ নেয়।
আইএসপিআরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীদের প্রথম আক্রমণেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ আলী শওকতসহ পাঁচজন সেনা সদস্য গুরুতর আহত হন। তাদের সবাই পরে আহত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। নিহত সেনাদের মধ্যে ছিলেন ল্যান্স নায়েক মুহাম্মদ আল্লাহ, ল্যান্স নায়েক আখতার জামান, ল্যান্স নায়েক শহীদুল্লাহ, ল্যান্স নায়েক ইউসুফ আলী এবং সিপাহী জামিল আহমেদ। সেনা সদস্যদের মৃত্যুতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে গভীর শোক নেমে এসেছে।
অপরদিকে, নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্টা হামলায় ছয়জন সন্ত্রাসী নিহত হয়। আইএসপিআর জানিয়েছে, নিহত সন্ত্রাসীরা ফিতনা আল খাওয়ারিজ নামক একটি সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য। এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষের মধ্যে ভারী গোলাগুলি বিনিময় হয়, যার ফলে এলাকাটি দীর্ঘক্ষণ উত্তেজনার মধ্যে ছিল।
উত্তর ওয়াজিরিস্তান দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। আফগান সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই অঞ্চলটি প্রায়ই সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের মঞ্চ হয়ে থাকে। বিশেষত, ২০০১ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ এবং আফগানিস্তানে তালেবান উৎখাতের পর থেকে এ অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বহুবার এই এলাকায় অভিযান চালিয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের দমনে শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সন্ত্রাসীরা বারবার সংগঠিত হয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়ে থাকে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এসব সংঘর্ষ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে দেখা হয়। তবে এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে, এবং এই অঞ্চলে বসবাসরত জনগণ প্রায়ই ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন।
এই সংঘর্ষের পর পাকিস্তানের আইএসপিআর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাদের লক্ষ্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম নির্মূল করা এবং দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আইএসপিআর আরও বলেছে, “পাকিস্তানের জনগণ এবং নিরাপত্তা বাহিনী একসঙ্গে সন্ত্রাসের মূলোচ্ছেদ করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এবং এই ধরনের ঘটনার পরও সেনাবাহিনীর মনোবল অটুট রয়েছে।”
এই সংঘর্ষের কয়েকদিন আগে সোয়াতের চারবাগ এলাকায় আরেকটি সফল অভিযান পরিচালিত হয়, যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো দুই সন্ত্রাসীকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এছাড়া অভিযানে আহত অবস্থায় এক সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়। পাকিস্তান সরকার এবং সেনাবাহিনী এই ধরনের অভিযান অব্যাহত রেখে দেশ থেকে সন্ত্রাসবাদ সম্পূর্ণভাবে দূর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বহু বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপজাতি এলাকায় তারা বেশ কয়েকটি বড় আকারের সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ‘অপারেশন জার্ব-ই-আজব’ এবং পরবর্তীতে ‘অপারেশন রাদ-উল-ফসাদ’ উল্লেখযোগ্য। এই অভিযানগুলো সন্ত্রাসীদের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য পরিচালিত হয়, এবং এর ফলে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
তবে, এসব অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাজার হাজার সেনা সদস্য সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। সাম্প্রতিক ঘটনাটিও এই ধারাবাহিক আত্মত্যাগের আরেকটি করুণ উদাহরণ। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ আলী শওকতসহ নিহত সৈন্যদের মৃত্যুতে পুরো জাতি শোকাহত। এই সেনা কর্মকর্তারা শুধু নিজের জীবন উৎসর্গ করেননি, বরং তারা দেশবাসীর জন্য শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
উত্তর ওয়াজিরিস্তান এবং অন্যান্য উপজাতি এলাকায় সন্ত্রাসবাদ দমনে পাকিস্তানের সামনে এখনও বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যদিও সেনাবাহিনীর অভিযানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে, তবুও তারা এখনও পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি এবং আফগানিস্তান থেকে আগত চরমপন্থীদের কার্যক্রম পাকিস্তানের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রতিনিয়ত নতুন কৌশল এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের জনগণের জন্যও সন্ত্রাসবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। এসব সংঘর্ষ এবং অভিযানের কারণে সাধারণ মানুষও প্রায়ই বিপদের মুখোমুখি হন। তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে, এবং অনেকেই নিরাপত্তার অভাবে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। নিরাপত্তা বাহিনী সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমনে কার্যকর হলেও সাধারণ মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান এখনো অধরা।
উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ ১২ জনের প্রাণহানি পাকিস্তানের চলমান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে, তবে এই লড়াইয়ে প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগ করতে হচ্ছে। দেশকে সন্ত্রাসবাদের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পাকিস্তানের সরকার এবং সেনাবাহিনীকে আরও কঠোরভাবে কাজ করতে হবে, পাশাপাশি জনগণের নিরাপত্তা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে।