বর্তমান বাংলাদেশে রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক প্রেক্ষাপট এক নতুন মোড় নিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা হঠাৎ করেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে সমগ্র দেশকে চমকে দিয়েছেন। তাদের দাবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি, যার মধ্যে রয়েছে নতুন সংবিধান প্রণয়ন, আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার এবং হাসিনার আমলে গৃহীত অবৈধ চুক্তি বাতিল। প্রশ্ন হল, সরকার কী এই দাবিগুলো মানবে, নাকি বর্তমান রাষ্ট্রপতি তার পদে বহাল থাকবেন?
এই উত্তাল দাবি সর্বপ্রথম আসে ৩ অক্টোবর দুপুরে, যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণের আহ্বান জানান। এর কয়েক ঘণ্টা পর আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমও একই দাবির কথা তার প্রোফাইলে শেয়ার করেন। তাঁদের এই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়।
এই দাবির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, “ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পরও তার নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি এখনও দায়িত্ব পালন করছেন, যা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।” তাদের মতে, মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে “ফ্যাসিজমের প্রতীক” হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং তার পদত্যাগ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন, যা অভিশংসন নামে পরিচিত। কিন্তু বর্তমান সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এই প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “এই মুহূর্তে সংসদ না থাকায় অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্ভব নয়। তবে রাষ্ট্রপতি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন, তখন কোনও আইনি জটিলতা থাকবে না।”
তবে সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করার সম্ভাবনা সম্পর্কেও তিনি মন্তব্য করেন, “কারও কথায় রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করা অসম্ভব কিছু না। ক্ষমতাসীন সরকার চাইলে এটি খুব দ্রুত ঘটতে পারে।” অর্থাৎ, সরকার যদি এই দাবিগুলো মেনে নিয়ে রাষ্ট্রপতির অপসারণের দিকে এগোয়, তবে তা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ঘটতে পারে, যদিও এতে কোনো সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে চলা হবে না।
বৈধতার প্রশ্নে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হাসনাত কাইয়ুম বলেন, “বর্তমান অস্বাভাবিক সরকার কাজ করছে, তাই সংবিধানের পথে বৈধতা বা অবৈধতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।” তার মতে, এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে একটি রেফারেন্স নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অর্থাৎ, সরকারের জন্য একটি আইনি ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা সম্ভব হতে পারে, যা সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা হবে।
রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ করেন বা পদত্যাগে বাধ্য হন, তখন তার পরিবর্তে কে দায়িত্ব নেবেন? সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্পিকার ও সংসদ দুটোই অনুপস্থিত, তাই এ বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যেহেতু নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হলে সংসদ প্রয়োজন, তাই রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া এটি সম্ভব নয়।
যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি এখন সবচেয়ে বড় দাবি হিসেবে উঠে এসেছে, তাদের অন্য দাবিগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি। তবে রাষ্ট্রপতির অপসারণই যদি এখনকার রাজনৈতিক সংলাপের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করা ইতিমধ্যেই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপকে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ইতিহাসে দেখা গেছে, তাদের পূর্ববর্তী দাবির পর সরকারের বিভিন্ন পদে পরিবর্তন এসেছে। সুতরাং, রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিটি সরকার মেনে নেবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা নিয়ে জনমনে ব্যাপক কৌতূহল রয়েছে। সংবিধানগত জটিলতা এবং রাজনৈতিক চাপের মুখে রাষ্ট্রপতির ভবিষ্যত কীভাবে নির্ধারিত হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।