বর্তমানে দেশের বাজার পরিস্থিতি ভোক্তাদের জন্য চরম উদ্বেগজনক। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে দিন দিন হতাশা বাড়ছে। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সবজি, ডিম, তেল, চাল—প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দামই আকাশচুম্বী। ফলে ক্রেতাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, ঠিক কত টাকা লাগবে একবারের বাজার করতে?
কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী হাসান আলীর সঙ্গে, যিনি রাজধানীর মিরপুর এলাকায় বসবাস করেন। বাজার নিয়ে তার অসহায়ত্ব ফুটে উঠল কথায়, ‘আগে মাছ-মাংস কমিয়ে দিয়েছিলাম, এখন সবজি কিনতেও হিমশিম খাচ্ছি। সবকিছুর দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে আমরা খেয়ে বাঁচব কীভাবে?’
হাসান আলীর মতো অসংখ্য মানুষ এখন এই প্রশ্নের মুখোমুখি। একসময় যে বাজার ৫০০ টাকায় করা যেত, এখন তার জন্য খরচ হচ্ছে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা। বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি পরিবার দৈনিক চাহিদার জন্য যে পরিমাণ পণ্য কিনতে চায়, সেটির জন্য প্রয়োজন হচ্ছে দ্বিগুণ বা তারও বেশি টাকা।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১.৮৭ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির দাম ১২.১২ শতাংশ, ফার্মের ডিম ৫.৭১ শতাংশ, এবং মুগ ডালের দাম বেড়েছে ৯.৬৮ শতাংশ। অন্য অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেও একই ধরনের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র দেখা গেছে।
বাজারে কিছু পণ্যের দাম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
মোটা চাল: ৪৮-৫০ টাকা প্রতি কেজি
পাঙাশ বা তেলাপিয়া মাছ: ১৮০-২৪০ টাকা প্রতি কেজি
আলু: ৫৫ টাকা প্রতি কেজি
পেঁয়াজ: ১১০ টাকা প্রতি কেজি
ব্রয়লার মুরগি: ২০০ টাকা প্রতি কেজি
মরিচ (৫০০ গ্রাম): ১৬০ টাকা
মোটা মসুর ডাল: ১০৫-১১০ টাকা প্রতি কেজি
খোলা সয়াবিন তেল: ১৬০ টাকা প্রতি লিটার
এই হিসাব অনুযায়ী, সামান্য পরিমাণের বাজার করতে গেলেও খরচ দাঁড়ায় ১,০০০ টাকার ওপরে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
বাজারের এই অস্থিরতার জন্য সরবরাহের ঘাটতি অনেকাংশে দায়ী। সাম্প্রতিক বন্যা এবং টানা বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষেত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার জানান, ‘বন্যা ও বৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমে গেছে। তাছাড়া শীতকালীন সবজি এখনো পুরোপুরি বাজারে আসেনি। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম স্বাভাবিকভাবেই বাড়তি।’
মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল আজিজ জানান, ‘ভারতে ইলিশ রফতানি বন্ধ এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় মাছের ঘের ভেসে যাওয়ার কারণে অন্যান্য মাছের দামও বেড়েছে।’ ইলিশের সরবরাহ সংকটে মাছের বাজারে প্রভাব পড়েছে, যা ভোক্তাদের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
পোলট্রি ব্যবসায়ীরা জানান, ডিম ও মুরগির বাজারেও একই ধরনের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ‘বিভিন্ন অজুহাতে সিন্ডিকেট করে ডিম-মুরগির দাম বাড়ানো হচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানির ফিড এবং মুরগির বাচ্চার সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারলে এই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে।’
তিনি আরও জানান, প্রান্তিক খামারিদের সঠিক মূল্য না পাওয়ার বিষয়টিও পণ্যের দামে প্রভাব ফেলছে। তাদের সঠিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হলে বাজারে দাম কমানো সম্ভব হবে।
নিত্যপণ্যের এই লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই। ক্রেতাদের অভিযোগ, বাজার মনিটরিং করা না হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে ফেলেন। অন্যদিকে বিক্রেতারা বলছেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে দামে কারসাজি করে যাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর মনিটরিং কার্যক্রম চালালে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘মাঝে কিছুদিনের জন্য পণ্যের দাম কমলেও, সেটি স্থায়ী হয়নি। বাজারের কারসাজি রোধ করতে হলে নিয়মিত অভিযান চালাতে হবে।’
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে হলে সরকারকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, ‘সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সংকটে পড়বে।’
মাহফুজ কবির আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গড় পরিসংখ্যান দিয়ে পুরো বাজারের চিত্র বোঝা যায় না। প্রতিটি পণ্যের আলাদা মূল্যপরিসংখ্যান প্রকাশ করা হলে পরিস্থিতি আরও স্বচ্ছ হবে।’
বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের জন্য একদিনের বাজার করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের তুলনায় অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে, কিন্তু পণ্যের মান ও পরিমাণ সেই তুলনায় কমে যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ক্রেতা ও বাজার বিশ্লেষকরা।