দুই দিনের টানা বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুরের ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ীসহ কয়েকটি উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। শতাধিক গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে, ভেসে গেছে ফসলের মাঠ, মাছের পুকুর। পানির প্রবল চাপ এবং নদী বাঁধের ভেঙে যাওয়া কয়েকটি এলাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শেরপুরের প্রধান নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। শুক্রবার (৪ অক্টোবর) দুপুর ১১টার আপডেট অনুযায়ী, নালিতাবাড়ীর ভোগাই নদীর নাকুগাঁও পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৭২ সেন্টিমিটার ওপরে, নালিতাবাড়ী পয়েন্টে ৫৬ সেন্টিমিটার ওপরে এবং চেল্লাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫২৬ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়েছে। ঝিনাইগাতী উপজেলা শহর ও আশপাশের এলাকা ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা জানান, নদীর পানির প্রবল চাপের কারণে ভোগাই নদীর দুই পাড়ে কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেলে এবং বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যার প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
পাহাড়ি ঢল ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে এলাকার কৃষি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় শেরপুরে ২২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বৃষ্টি এবং ঢলের পানি এলাকায় ঢুকে পড়ায় শত শত পুকুর, ধানের জমি, এবং সবজি ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে স্থানীয় কৃষকরা চরম বিপাকে পড়েছেন। তাদের অনেকের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা খাদ্য সংকট তৈরি করতে পারে।
পাহাড়ি ঢলের পানি ঝিনাইগাতী উপজেলা শহরে প্রবেশ করে সেখানকার প্রধান সড়ক, বাজার, অফিস, এবং স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়া পরিবারগুলো ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। অনেক পরিবার উঁচু স্থানে কিংবা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। তবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, “আমাদের ঘরের ভেতর ৩-৪ ফুট পানি জমে আছে। আমরা কোনোভাবে বাচ্চাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে উঠেছি, কিন্তু খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট চলছে। প্রশাসনের কোনো সহায়তা এখনো পাইনি।”
বন্যাদুর্গত এলাকার বাসিন্দারা জানান, এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ত্রাণ বা সহায়তা পৌঁছেনি। তারা আশঙ্কা করছেন, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে এবং তারা দীর্ঘ সময় পানিবন্দি অবস্থায় কাটাতে বাধ্য হবেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এখনও সঠিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
অপরদিকে শ্রীবরদীর সীমান্তবর্তী এলাকা, যেখানে ভারত থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানকার পরিস্থিতি আরও গুরুতর। নদীর আশপাশের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে যাওয়ায় শত শত পুকুর, সবজি ক্ষেত ও ধানের জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া এই এলাকায় বড় ধরনের ফসল ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা মনে করছেন, বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকলে তাদের পক্ষে আগামী কয়েক মাস ফসল ফলানো সম্ভব হবে না।
শেরপুরের পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গেলেও, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় আসতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীগুলোর পানি প্রবাহ যদি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে না আসে, তাহলে শুধু নিম্নাঞ্চল নয়, জেলার আরও বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে নদীর পানি আরও বাড়বে, যা বাঁধ ভাঙা এবং প্লাবনের পরিধি বাড়িয়ে দেবে। তবে স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যেই জরুরি উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
এই বন্যা পরিস্থিতিতে পানিবাহিত রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে পানিতে ডুবে থাকা এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব ও অপরিষ্কার পরিবেশের কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। এছাড়া বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা এবং স্যানিটেশনের অভাবে জনস্বাস্থ্য আরও ঝুঁকিতে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে মেডিক্যাল টিম গঠন ও জরুরি চিকিৎসা সেবা দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
শেরপুরের এই পাহাড়ি ঢল ও বন্যা পরিস্থিতি স্থানীয় জনগণের জন্য এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষজন ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে, কিন্তু প্রশাসনের সহায়তা ও ত্রাণ কার্যক্রমের দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। এই মুহূর্তে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সরকারকে দ্রুত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো যায় এবং ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।