নীলফামারী জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগের আরও ১৬ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এর আগে, বুধবার রাতে আরও ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এ নিয়ে মোট ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হলো। এসব অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ও আলোচনা বাড়ছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ডোমার, জলঢাকা, ডিমলা, কিশোরীগঞ্জ ও সদর উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। নীলফামারী সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ জানান, অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক আইনি প্রক্রিয়া শেষে বিকেলে আদালতে হাজির করা হয় এবং আদালত তাদের জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ডোমার উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নের আনোয়ারুল হক (৬৫), জলঢাকা উপজেলার মানিক হোসেন (২৫), হেলাল হোসেন (৪২), জাহাঙ্গীর আলম (৩৭), রুবেল ইসলাম (২৬), গোলাম মোস্তফা (২৬), বিলাস চন্দ্র বর্মণ (৪২), সোহেল রানা (২১), প্রমথ কুমার রায় (৪৫), জিয়াউর রহমান (৪৪), আরিফ হোসেন (২৫), মিজানুর রহমান (৫৮), জনি মিয়া (৪২), সেলিম হোসেন (৩৮), রতন চন্দ্র বিশ্বাস (৩০), এবং জুয়েল ইসলাম (৪১)।
গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত। সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, ‘এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই বিভিন্ন থানায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মামলা ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টার্গেট ছিল মূলত তারা যারা সরাসরি এই ধরনের অপরাধে যুক্ত রয়েছেন।’
ওসি সাঈদ আরও জানান, ‘এই বিশেষ অভিযান চলবে এবং আইন অনুযায়ী যারা দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’
এই অভিযানের আগের রাতে, অর্থাৎ ৩ অক্টোবর, আরও ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নেতাও ছিলেন। এর ফলে মোট ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই গ্রেফতার প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতারা এই গ্রেফতার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যায়িত করেছেন, যেখানে বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মীরা এর পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেখছেন।
সদর থানার ওসি আরও জানান, ‘জেলা জুড়ে দ্বিতীয় দফার অভিযানে ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এ নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগের ৭১ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূরসহ আরও ৪১ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলাও রয়েছে। এই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে।’
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এই গ্রেফতারের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকার অভিযোগ তুলেছেন। তারা দাবি করেছেন, ‘নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে এবং বিরোধী পক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে।’
গ্রেফতারকৃত নেতাদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠনকে চালিয়ে আসছিলেন। গ্রেফতারের পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতারা এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ‘এই গ্রেফতার প্রক্রিয়া দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এবং দলের শক্তি দুর্বল করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।’
এদিকে, জেলার সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এই গ্রেফতারগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী বার্তা হিসেবেই দেখছেন। তারা মনে করছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের অভিযানে কোনো পক্ষপাতিত্ব না করে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।’
নীলফামারী সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘এই অভিযানের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। আমরা রাজনৈতিক পরিচয় নয়, অপরাধের ভিত্তিতে গ্রেফতার করেছি। যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং মামলা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এ ধরনের অভিযান চলবে এবং অপরাধীদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা কোনো দল বা গোষ্ঠীকে নয়, বরং অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে চাই।’
এই বিশেষ অভিযান এবং গ্রেফতার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে বলেও জানা গেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, এই অভিযানগুলি শুধু সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দমনের জন্য নয়, বরং রাজনৈতিক অঙ্গনে ভারসাম্য রক্ষা এবং নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অংশ হিসেবেও দেখা হতে পারে।
নীলফামারীর এই বিশেষ অভিযান দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে এবং এটি আরও কয়েকটি জেলার রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।