দেশের আকাশসীমা নিরাপদ রাখতে এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ফ্রান্সের থ্যালাস কোম্পানি থেকে ৭৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রাডার সংগ্রহ করেছে। নতুন এই রাডার বর্তমানে পুরোপুরি সক্রিয় এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি চট্টগ্রামে আরও একটি রাডার অপারেশনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এর ফলে দেশের আকাশসীমা এখন আগের চেয়ে আরও নিরাপদ ও সুরক্ষিত অবস্থায় আছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এই অত্যাধুনিক রাডার স্থাপন প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে শুরুতেই কিছু বিতর্ক উঠেছিল। ব্যয়ের বিশাল অঙ্ক এবং রাডারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা হলেও তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিষয়টি দেখভাল করেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পদ্ধতিতে রাডার কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে ২০২১ সালের এপ্রিলে সিএনএস-এটিএম (কমিউনিকেশন, নেভিগেশন অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স-এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট) ব্যবস্থাসহ রাডার স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন পায়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এই প্রকল্পের ব্যয় অনুমোদিত হয় প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা, যা বেবিচকের নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করা হয়।
ফ্রান্সের রাডার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থ্যালাসের সঙ্গে চুক্তি করে ২০২১ সালের অক্টোবরে এই রাডার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০২৩ সালের নভেম্বরে অত্যাধুনিক রাডার বসানোর কাজ সম্পন্ন হয় এবং ধীরে ধীরে তা কার্যকর হতে থাকে। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে এই রাডার পুরোপুরি অপারেশন শুরু করেছে। নতুন রাডারটি বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) কার্যক্রমকে আরও উন্নত করেছে এবং বাংলাদেশকে আকাশসীমা নিরাপত্তায় আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সদস্য এয়ার কমোডর জিয়াউল হক জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরের নতুন রাডার এখন সম্পূর্ণরূপে কাজ করছে এবং এটি বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি। নতুন এয়ার ট্রাফিক সিস্টেম (এটিএস) দেশের মর্যাদা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বৃদ্ধি করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শুধু ঢাকা নয়, দেশের দক্ষিণ অংশ তথা সমুদ্রসীমাও নতুন রাডারের আওতায় রয়েছে। এদিকে চট্টগ্রামে আরও একটি রাডার অপারেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও চট্টগ্রামের এই রাডারটি ২০১৭ সালে জাইকার সহায়তায় স্থাপন করা হয়, তা বিভিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা এবং করোনা মহামারির কারণে সময়মতো চালু করা যায়নি। পরে ২০২২ সালে এটি একবার চালু হলেও টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে জাপানের এনইসি কোম্পানির সহায়তায় এর টেকনিক্যাল সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলছে এবং এটি খুব দ্রুতই আবার চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে, বিমানবাহিনীর নিজস্ব রাডার সিস্টেমও দেশের আকাশসীমা পর্যবেক্ষণের জন্য সক্রিয় রয়েছে। বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, বিমানবাহিনীর এই রাডারগুলোও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ফলে নতুন এবং পুরনো রাডারের সমন্বয়ে দেশের আকাশসীমা এখন সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত।
নতুন রাডার স্থাপনের ফলে দেশের আকাশসীমা থেকে প্রাপ্ত ওভারফ্লাইং রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত প্রায় ৯ অর্থবছরে ওভারফ্লাইং আয় ১,৫০০ থেকে ১,৮০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে নতুন রাডার সংযোজনের ফলে আগামীতে এই আয় আড়াই থেকে ৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে করে দেশের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থায় আরও বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ নিশ্চিত হবে।
নতুন রাডারের কার্যকারিতা এবং ব্যয় নিয়ে প্রাথমিক সমালোচনা থাকলেও, প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন এখন দেশের জন্য একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্যও ছড়ানো হয়েছিল চট্টগ্রামের রাডার নিয়ে। তবে বেবিচক কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে জানিয়েছে, চট্টগ্রামের রাডার এখনও চালু না হলেও ঢাকার রাডার দিয়ে সমুদ্রসীমাসহ পুরো দক্ষিণ অংশ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুরনো রাডারগুলোও নিয়মিত আপগ্রেড ও ওভারহোলিংয়ের মাধ্যমে সচল রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রামের রাডার অপারেশন শুরু হলে দেশের আকাশসীমা পর্যবেক্ষণ আরও সুসংহত হবে এবং আকাশসীমার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরও উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ভবিষ্যতে আরও নতুন রাডার প্রযুক্তি এবং এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম আনার পরিকল্পনাও রয়েছে।