ভারতের বন্যা-আগ্রাসন প্রতিরোধ ও আন্তঃদেশীয় নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার দাবিতে বাংলাদেশ সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান বুধবার (২ অক্টোবর) এই নোটিশটি পাঠান। এই নোটিশের মাধ্যমে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে উক্ত বিষয়গুলোতে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃদেশীয় নদী রয়েছে, যার মধ্যে ৫৩টি নদী ভারতের উজান থেকে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারত উজানে অবৈধভাবে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে পানি আটকে রাখছে এবং নদীর প্রবাহ পরিবর্তন করে ভারতেই পানি প্রবাহিত করছে। এর ফলে, বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলে নদীগুলোর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে এবং নাব্যতা হারাচ্ছে। এমনকি, নদীগুলো ক্রমশ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে।
এই ধরনের পানি সংকট বাংলাদেশে একদিকে কৃষি, মৎস্য, ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ফেলছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ফলে, বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত একটি বিশাল সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, যা দেশের জনজীবন, কৃষি, অর্থনীতি এবং পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
নোটিশে আরও বলা হয়েছে, যখন ভারতের উজানের নদীগুলোতে অতিরিক্ত পানি সঞ্চিত হয়, তখন ভারত বাঁধ ও ব্যারেজগুলোর গেট খুলে দেয়, যার ফলে বাংলাদেশের ভাটির অংশে অপ্রত্যাশিত পানির ঢল নামায়। এভাবে সৃষ্ট বন্যা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। প্রতিবছর এই কৃত্রিম বন্যার ফলে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, গবাদিপশু এবং রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ধ্বংস হয়। ফলে, বাংলাদেশের প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
ভারতের এই ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক নীতি ও আইন লঙ্ঘনের সামিল, যেখানে আন্তঃদেশীয় নদীর পানি ব্যবহারে উজানের দেশ কর্তৃক ভাটির দেশের পানির প্রাপ্যতা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কোর্স’ অনুযায়ী আন্তঃদেশীয় নদীর ক্ষেত্রে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান এবং প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে উভয় দেশকে সমতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্রের কারণে যদি আন্তঃদেশীয় নদীর পানি প্রবাহে অন্য রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে দায়ী রাষ্ট্রকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশ এখনো এই আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। নোটিশে এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয় যে, ভারতের চাপের কারণে বাংলাদেশ এই কনভেনশনে যোগ দিতে পারেনি, যা বাংলাদেশের পানিসম্পদ সুরক্ষার জন্য এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নোটিশে আহ্বান জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশকে অবশ্যই জাতিসংঘের পানি প্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর করতে হবে এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে হবে।
নোটিশে দাবি করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের কনভেনশনের আলোকে বাংলাদেশের প্রতি ভারত সরকারের অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতীয় আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশে সৃষ্ট বন্যা ও পানিসংকটের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ট্রিলিয়ন ডলারের দাবি জানানো উচিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের পানি আগ্রাসন এবং এর ফলে বাংলাদেশে সৃষ্ট বন্যার কারণে কৃষি উৎপাদন, অবকাঠামো এবং নাগরিক জীবনে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার সঠিক মূল্যায়ন করা এবং ক্ষতিপূরণের দাবিতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করার কথাও বলা হয়েছে নোটিশে।
আইনি নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, সাত দিনের মধ্যে এই সমস্যার যথাযথ সমাধান করতে হবে। ভারত সরকারের পানি আগ্রাসনের প্রতিরোধ এবং আন্তঃদেশীয় নদীগুলোতে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উল্লিখিত মন্ত্রণালয়গুলোকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নোটিশে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, যদি সাত দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করা হবে।
বাংলাদেশের জনজীবনে পানি সমস্যা এবং ভারতীয় আগ্রাসনের ফলে সৃষ্ট বন্যা একটি গভীর সংকটের দিকে ইঙ্গিত করছে। এই সংকট শুধু বর্তমান প্রজন্মকেই নয়, বরং ভবিষ্যত প্রজন্মকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। তাই, পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে ভারতের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশ সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
অন্তর্দেশীয় নদীগুলোর পানি সংকটের দ্রুত সমাধান করতে হলে, বাংলাদেশকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পথ খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায়, এই সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে, যা দেশের জনগণের জন্য এক বিশাল বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।