সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার মামলার তদন্তের দায়িত্ব থেকে র্যাবকে সরিয়ে আদালত নতুন এক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় পরও হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা না হওয়ায় এবং তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় মামলার তদন্তের দায়িত্ব থেকে র্যাবকে সরিয়ে পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্তভার দেওয়ার নির্দেশনা আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে মামলাটির শুনানি হয়, যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে র্যাবকে তদন্ত থেকে সরানোর আবেদন করা হয়।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে নিজ বাসা থেকে বিখ্যাত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশের গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম উত্তেজনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ঘটনার পর কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়, আর তদন্ত অগ্রগতির অভাবে এ রহস্য এখনো অমীমাংসিত।
প্রথমে মামলাটি পুলিশের অধীনে ছিল। তারপর তদন্তের দায়িত্বভার চলে যায় সিআইডির (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট) হাতে। কিন্তু তদন্তে কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য না পাওয়ায়, মামলাটি শেষমেশ র্যাবের হাতে ন্যস্ত হয়। কিন্তু এখানেও কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তারা হত্যা মামলাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এরই প্রেক্ষিতে, মামলার বাদী মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমান আদালতে নতুন করে র্যাবের দায়িত্ব থেকে সরানোর দাবি তোলেন। রোমান বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করেছি, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে কোনো অগ্রগতি দেখছি না। এটি স্পষ্ট যে, র্যাবের হাতে তদন্ত থাকলে আমরা কোনো ফলাফল দেখতে পাবো না।”
রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) আদালতে শুনানির সময় রোমান বলেন, “যখনই আমরা মামলাটি র্যাবের হাতে যাওয়ার খবর শুনি, তখনই আমরা আশাহত হই। কারণ, এটি স্পষ্ট যে তদন্তের গতি স্লথ হচ্ছে এবং কোনো সমাধান আসছে না।”
এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বারবার সময় নির্ধারণ করা হলেও, ১১৩ বার সেই সময় পিছিয়ে গেছে। তদন্ত সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের রোমান কিছুটা আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। তিনি নতুন আইনজীবী হিসেবে শিশির মনিরকে নিয়োগ দিয়েছেন, যিনি এ মামলায় নতুন করে প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
নিয়োগ পাওয়া নতুন আইনজীবী শিশির মনির জানান, “যদি আন্তরিকভাবে কাজ করা হতো, এতদিনে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন সম্ভব হতো। আমাদের লক্ষ্য এখন মামলাটির তদন্তের ভার পিবিআইকে হস্তান্তর করা, যাতে তারা সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে তদন্ত করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এখন সময় এসেছে এই মামলাকে একটি নিরপেক্ষ ও দক্ষ তদন্ত সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার। আমরা আদালতে আবেদন করেছি, যাতে পিবিআইকে এই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়। পিবিআই অতীতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে, তাই আমরা তাদের উপর আস্থা রাখছি।”
সবশেষ তদন্তে জানা যায় যে, সাগর-রুনির বাসা থেকে অজ্ঞাত দুই ব্যক্তির ডিএনএ আলামত পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত সেই ডিএনএ আলামতের সাথে খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
এ ঘটনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, প্রমাণ সংগ্রহ ও তা বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং সময়ের অপচয়। আলামত সংগ্রহের পর তা যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করার কারণে তদন্তে ধীরগতি এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। সাংবাদিক সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন। কিন্তু এতদিনেও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায়, মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অনেকেই মনে করছেন, তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব বা অন্যান্য কারণে মামলাটির রহস্য ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে।
এখন মামলাটি পিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। অনেকেই আশাবাদী যে, পিবিআই যদি তদন্তের দায়িত্ব পায়, তাহলে সঠিকভাবে তদন্ত করা হবে এবং হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন হবে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে কাজ করলে পিবিআই অল্প সময়ের মধ্যেই মামলাটির অগ্রগতি আনতে সক্ষম হবে। কারণ, পিবিআই ইতোমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলায় সফলতা দেখিয়েছে।
সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা আশা করছেন, নতুন আইনজীবী এবং নতুন তদন্ত সংস্থা মিলে এই পুরোনো ও অত্যন্ত সংবেদনশীল মামলাটির সঠিক নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হবে।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আজও দেশের মানুষের মনে গভীর দাগ কেটে আছে। দীর্ঘ এক যুগ পরও হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা না হওয়া দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তবে নতুন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, তদন্তভার বদলানোর সম্ভাবনা, এবং নতুন আইনজীবীর নিয়োগ মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
সঠিক তদন্ত ও বিচার পেলে সাগর-রুনির পরিবার এবং দেশের সাংবাদিক সমাজ অবশেষে কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। তদন্তের এই নতুন মোড় এক যুগের পুরনো এই মামলাকে একটি গতি দিতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত দেশের ইতিহাসের এক অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে সহায়তা করতে পারে।