নিজস্ব প্রতিবেদক, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪:
উজানের পানির প্রবল ঢলে তিস্তা নদীর পানি দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন বন্যার পানির নিচে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) ভোর ৬টা থেকে ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার এবং কাউনিয়া পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার ওপরে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, আদিতমারীসহ রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীর তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
বন্যার তীব্রতায় নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা চরম ভোগান্তির সম্মুখীন। সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হওয়ায় এবং বসতবাড়িতে পানি প্রবেশ করায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বন্যার পানির চাপে লালমনিরহাটের ছয়টি উপজেলার চরাঞ্চলের নতুন কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এলাকার মানুষজন বিভিন্ন উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। যেসব এলাকায় এখনও পানি প্রবেশ করেনি, সেসব এলাকাতেও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বন্যার কারণে নিম্নাঞ্চলের ভয়াবহ পরিস্থিতি
তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে বইতে থাকায় তিস্তা অববাহিকার অধিকাংশ এলাকা ডুবে গেছে। লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জসহ অন্যান্য এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে রওনা দিয়েছেন। পানি ঢুকে যাওয়ায় অসংখ্য পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে স্কুল, সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র বা উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক জায়গায় রাস্তা-ঘাটের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে, ফলে সড়ক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
নিম্নাঞ্চলের মানুষজন জানান, তাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে এবং তারা প্রায় পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই খাদ্য, পানীয় জল এবং চিকিৎসা সেবা সংকটে পড়েছেন। এছাড়া, বিশুদ্ধ পানির সংকট তৈরি হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একইসঙ্গে, চারণ ভূমি এবং ফসলের জমিও পানির নিচে ডুবে গেছে, যা কৃষকদের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনেক স্থানে গবাদি পশুর খাদ্যেরও সংকট দেখা দিয়েছে। চরাঞ্চলের কৃষকরা শঙ্কিত, এই বন্যায় তাদের ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা
তিস্তার পানি প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায়, তিস্তা ব্যারেজসহ অন্যান্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে লালমনিরহাটের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোর অবস্থা বেশ সংকটপূর্ণ বলে জানা গেছে। পানির চাপে বাঁধগুলো যে কোনো সময় ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বাঁধগুলোর উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন এবং এলাকাবাসীদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাঁধগুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। কিছু এলাকায় বালির বস্তা দিয়ে বাঁধগুলোকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা চলছে। তবে প্রবল পানির চাপের কারণে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
পানিবন্দি মানুষ ও খাদ্য সংকট
বন্যার কারণে লালমনিরহাটসহ রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। অনেক পরিবার প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে পারছেন না, ফলে তাদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা শুরু হলেও অনেক দুর্গম অঞ্চলে তা এখনো পৌঁছাতে পারেনি।
সরকারি সূত্র থেকে জানা গেছে, এরই মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে এবং বন্যার্তদের মধ্যে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও ঔষধ বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও, দুর্গত এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বন্যাকবলিত মানুষদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে দুর্গম চরাঞ্চলের অনেক পরিবার এখনো ত্রাণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত।
স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতি
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রয়োজনে আরও আশ্রয়কেন্দ্র খোলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে পানিবন্দি মানুষগুলো নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেন, উজান থেকে আসা পানির ঢল কমলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে পরিস্থিতি কীভাবে পরিবর্তিত হবে। বর্তমানে দফায় দফায় ভারী বর্ষণ এবং উজানের পানির প্রবাহের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
বন্যার সম্ভাব্য দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব
বন্যার কারণে তিস্তা অববাহিকার কৃষি জমিগুলো ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। চলতি মৌসুমে ধানসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই বন্যার প্রভাব খাদ্য সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে, কারণ তিস্তা অববাহিকার কৃষিজমি দেশের খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এর পাশাপাশি, দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে সড়ক, সেতু এবং অন্যান্য অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা পুনরুদ্ধার করতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কতা
পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে উজানের পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তা নদীর পানির আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিশেষ করে যদি ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নদীর পানি পরিস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে এবং স্থানীয়দের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়েছে যে, তিস্তার পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনা নদীর পানিও বিপৎসীমার কাছাকাছি রয়েছে। ফলে, উত্তরাঞ্চলের আরও বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ বিপৎসীমা অতিক্রম করায় তিস্তা অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েছে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে বন্যা পরিস্থিতি কতদিন স্থায়ী হবে তা এখনও অনিশ্চিত।