বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, যা ১২০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, সারা বছরই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে। বিশেষ করে লাবনী, সুগন্ধা, ও কলাতলী পয়েন্টগুলিতে ভিড় লেগে থাকে সবসময়। শীতকালীন সময়ে পর্যটকদের সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যায়। তবুও, এ সৈকতের সৌন্দর্য দিন দিন ম্লান হয়ে আসছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার কারণে।
অপার সম্ভাবনা কাজে লাগছে না
কক্সবাজার সৈকতের অপার সম্ভাবনা থাকার পরেও এটি উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও অবকাঠামো উন্নয়নের অভাবে এ অঞ্চলের পর্যটনের পূর্ণ সম্ভাবনা এখনো অন্বেষণ করা হয়নি। আন্তর্জাতিক মানের পর্যটকদের আকর্ষণ করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও আধুনিক সুবিধা, যা এখানকার অবকাঠামোয় অনুপস্থিত।
পর্যটকদের নিরাপত্তায় ঘাটতি
পর্যটকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কক্সবাজারে পর্যাপ্ত লাইফগার্ড, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, এবং মেডিকেল সুবিধা অপ্রতুল। লাইফগার্ড টিমের সদস্য সংখ্যা মাত্র ২৭ জন, যা এমন বৃহৎ অঞ্চলের জন্য একেবারেই অপ্রতুল। এছাড়া, তাদের উদ্ধার কাজে ব্যবহারের মতো পর্যাপ্ত বোট, স্ট্রেচার, টিউবসহ অন্যান্য সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
লাইফগার্ড টিমের সদস্যরা জানান, পর্যাপ্ত ইক্যুইপমেন্ট না থাকায় উদ্ধার কাজের সময় তাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। যদি পর্যাপ্ত দ্রুতযান ও আরও উন্নত ইক্যুইপমেন্ট সরবরাহ করা হয়, তবে দুর্ঘটনা কবলিত পর্যটকদের দ্রুত ও কার্যকরভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। এছাড়া, পর্যাপ্ত সরঞ্জাম থাকলে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
পর্যটকদের চাহিদা ও নিরাপত্তার অভাব
বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকত হিসেবে পরিচিত কক্সবাজার হলেও এখানে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়া এবং সুযোগ-সুবিধার অভাব এ জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। অনেক বিদেশি পর্যটক নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে কক্সবাজারকে তাদের গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেন না।
দেশীয় পর্যটকরাও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। সাগরে নামার সময় পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত লাইফগার্ড, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র এবং অ্যাম্বুলেন্স সেবার অভাব বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মেডিকেল সুবিধার অভাব
‘সী সেইফ লাইফগার্ড’-এর ফিল্ড টিম ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ জানান, কক্সবাজার সৈকতে একটি মেডিকেল সাবসেন্টার স্থাপন করা জরুরি, যেখানে দুর্ঘটনা কবলিত পর্যটকদের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা যাবে। বিশেষ করে পানিতে ডুবে যাওয়া কোনো পর্যটককে উদ্ধারের পর দ্রুত ও সঠিক চিকিৎসা প্রদানের সুবিধা এখানে নেই। পর্যাপ্ত মেডিকেল সরঞ্জাম এবং প্রশিক্ষিত মেডিকেল টিম থাকলে অনেক প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
পরিকল্পনার অভাব ও সম্ভাবনা
কক্সবাজারের পর্যটনখাতের উন্নয়নের জন্য অনেক পরিকল্পনা প্রস্তাবিত হলেও, সেগুলোর অধিকাংশই আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। কক্সবাজার বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব রায়হান উদ্দিন জানান, “পর্যটকদের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাগুলো ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমাদের আরও কর্মী নিয়োগ, অবকাঠামোর আধুনিকায়ন এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। আমরা কমিটির মাধ্যমে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছি।”
দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা
কক্সবাজার সৈকতের নিরাপত্তাহীনতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো গত পাঁচ বছরে এখানে সাগরে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা। কক্সবাজারে গত ৫ বছরে সাগরে ডুবে মোট ৪৭ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। পর্যাপ্ত লাইফগার্ড ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব থাকলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়।
পর্যটকবান্ধব সৈকত গড়ার জন্য করণীয়
কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আরও পরিকল্পিত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পর্যাপ্ত লাইফগার্ড, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না গেলে কক্সবাজার তার পর্যটন সম্ভাবনার পূর্ণতা লাভ করতে পারবে না।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হিসেবে কক্সবাজারের যে খ্যাতি, তা ধরে রাখতে এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করতে হলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং পর্যটকদের সুবিধা বৃদ্ধিতে আরও মনোযোগ দিতে হবে।