নিউইয়র্ক, ২৫ সেপ্টেম্বর:
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করা উচিত। তিনি বলেন, যদি শেখ হাসিনা অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তারও বিচার হওয়া উচিত।
ড. ইউনূসের এই মন্তব্য আসে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয়, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিরুদ্ধে বিচার করা উচিত কি-না। পাল্টা প্রশ্ন হিসেবে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “কেনো উচিত হবে না?” তিনি আরও যোগ করেন, “যদি অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তাকে বিচার করা উচিত। বিচার সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।”
এই মন্তব্যের মাধ্যমে ড. ইউনূস এক ধরনের বার্তা দেন যে, দেশের আইনের সামনে সবাই সমান। এমনকি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও এর বাইরে নয়।
নিউইয়র্ক টাইমসের ‘ক্লাইমেট ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসের ভাষণ
নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ এই অধিবেশনের মধ্যে, ক্লাইমেট চেঞ্জ এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন ড. ইউনূস।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ড. ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণ
বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে দেশের নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনা তীব্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল দেশে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও দুর্নীতির অভিযোগ। এরপর, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতা গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে ড. ইউনূস বলেন, তার সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের আয়োজন করা।
নির্বাচনের সময়সীমা এবং সরকারী পরিকল্পনা
ড. ইউনূসের মতে, বাংলাদেশে কবে নির্বাচন হবে তা নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “আমার কাছে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।” তার নেতৃত্বাধীন সরকার ইতিমধ্যে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে, যারা সামনের মাসগুলোতে দেশের রাজনৈতিক কাঠামো সংস্কারে সুপারিশ করবে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে, দেশে নির্বাচন আয়োজনের একটি তারিখ নির্ধারণ করা হবে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনর্বহাল করা।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে ড. ইউনূসের অবস্থান
একজন সাংবাদিকের প্রশ্নে ড. ইউনূস পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, তার নির্বাচনে দাঁড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি নির্বাচনে লড়ব?” এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে তার একমাত্র লক্ষ্য দেশের সেবা করা, ব্যক্তিগত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়।
মব জাস্টিস নিয়ে ড. ইউনূসের মতামত
অনুষ্ঠানে গণপিটুনি বা মব জাস্টিস প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে, ড. ইউনূস বলেন, বিদেশি মিডিয়া এ বিষয়ে ‘অতিরঞ্জিত’ খবর প্রকাশ করছে। তার মতে, বাংলাদেশে যা ঘটছে তা নিয়ে বিদেশি মিডিয়াগুলো বাড়িয়ে বলছে। তিনি বলেন, “বাইরে থেকে আপনারা যেসব রিপোর্ট পাচ্ছেন তা অতিরঞ্জিত। বাংলাদেশে আসুন এবং নিজের চোখে যা দেখবেন সেটাই রিপোর্ট করুন।”
মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং বৈদেশিক মিডিয়াকে আমন্ত্রণ
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশে এসে প্রকৃত পরিস্থিতি দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বাইরে যেসব খবর প্রচারিত হচ্ছে তার মধ্যে অনেকটাই বাস্তবতার সাথে মেলে না। তাই সাংবাদিকদের নিজ চোখে পরিস্থিতি দেখার আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনার অপরাধের অভিযোগ এবং ড. ইউনূসের বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি
ড. ইউনূসের বক্তব্য অনুযায়ী, আইনের সামনে সব মানুষ সমান এবং যদি শেখ হাসিনা সত্যিই অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তার বিচার হওয়া উচিত। এটি একটি স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচারের নীতি।
তার এই বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক পরিসরে গভীর প্রভাব ফেলেছে। শেখ হাসিনার দল এবং সমর্থকরা এ বিষয়ে কী প্রতিক্রিয়া জানাবে তা সময়ই বলে দেবে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সামনের পরিকল্পনা
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক সংস্কার এবং নতুন নির্বাচনের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। ড. ইউনূস বলেছেন, তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করছেন। তবে, এটি সম্পন্ন হতে কত সময় লাগবে তা তিনি স্পষ্ট করেননি।
তিনি বলেন, বর্তমানে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী দেশে নির্বাচন আয়োজন করা হবে। দেশের মানুষের অধিকার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই তার সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. ইউনূসের ভূমিকা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল বিজয়ী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত। তিনি মাইক্রোক্রেডিট ধারণার মাধ্যমে গরীবদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও গুরুত্ব পাচ্ছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করছে। তার নেতৃত্বে দেশের রাজনৈতিক সংস্কার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।