কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনায় সশস্ত্র ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম ছরওয়ার নির্জন (২২)। আজ মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ভোররাতে ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পূর্ব মাইজপাড়া এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় অভিযুক্ত ছয়জন ডাকাত-সন্ত্রাসীকে আটক করেছে পুলিশ।
চকরিয়া থানার ওসি মো. মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া জানান, ভোর ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে পূর্ব মাইজপাড়ার একটি বাড়িতে ডাকাতির খবর পেয়ে যৌথ বাহিনী সেখানে অভিযান চালায়। অভিযানে লেফটেন্যান্ট তানজিম ছরওয়ার নির্জন সশস্ত্র এক ডাকাতকে জাপটে ধরেন। এ সময় ডাকাত দলের সদস্যরা তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত এবং গুলি করে। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাকে দ্রুত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তবে পথিমধ্যে রামু এলাকায় তিনি মারা যান।
তানজিম ছরওয়ার নির্জনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। তার পরিবার, স্বজন এবং এলাকাবাসী গভীর শোকে মুহ্যমান। পরিবার সূত্রে জানা যায়, তানজিম ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। চলতি বছরের ডিসেম্বরে তার ক্যাপ্টেন হওয়ার কথা ছিল। এই দুঃসংবাদে পুরো এলাকাবাসী শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ডুলাহাজারার রিভার্জপাড়া, কাটাখালী, এবং ডুমখালী এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে পরিচিত থাকলেও, সম্প্রতি এই এলাকাটি সশস্ত্র ডাকাত ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ডাকাত দল নিয়মিতভাবে এই অঞ্চল থেকে আশেপাশের গ্রামগুলোতে ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেক চেষ্টা করেও এই সংঘবদ্ধ ডাকাতদের দমন করতে পারেনি, কারণ তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে এবং তাদের সদস্যসংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক।
লেফটেন্যান্ট তানজিমের বোনের সঙ্গে গতকাল সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) শেষবারের মতো কথা হয়। তিনি তার বোনকে বলেছিলেন, ‘আপু, একটা অপারেশনে যাচ্ছি। অনেক অস্ত্র নিয়ে যেতে হচ্ছে। আমার জন্য দোয়া কোরো, আমাকে মাফ করে দিয়ো।’ এই কথাগুলো এখন পরিবার এবং স্বজনদের হৃদয়ে গভীর শোক এবং বেদনা সৃষ্টি করেছে।
চকরিয়া থানার ওসি মো. মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে জানান, ডাকাতি কবলিত বাড়িতে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ডাকাত ও সন্ত্রাসীরা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এই সময় সেনা কর্মকর্তা তানজিম ছরওয়ার নির্জনকে আক্রমণ করা হলে তিনি গুরুতর আহত হন এবং পরে মারা যান। অভিযানের পর থেকে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী এলাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছয়জন ডাকাতকে আটক করেছে। তবে এই ঘটনার বিস্তারিত এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আরও তথ্য পরবর্তীতে জানানো হবে।
ডুলাহাজারার আশপাশের বাসিন্দারা এই ঘটনার পর থেকে বেশ আতঙ্কিত। তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করেছে যাতে এই অঞ্চলে সন্ত্রাস এবং ডাকাতি চিরতরে বন্ধ করা হয়। এলাকাবাসী আরও জানিয়েছেন, সংরক্ষিত বনভূমিতে ডাকাতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের অপরাধের শিকার হতে পারে তারা।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে ডাকাতদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং তাদের নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোরভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
লেফটেন্যান্ট তানজিম ছরওয়ার নির্জনের মৃত্যুতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ দেশের বিভিন্ন মহল থেকে শোকবার্তা পাঠানো হচ্ছে। একজন উদীয়মান সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেবা করে যাচ্ছিলেন, এবং তার এই আত্মত্যাগ দেশের জন্য এক বিরাট ক্ষতি।