১৫ জুলাই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সকাল থেকেই মেসের রুমমেট ও বন্ধুদের মধ্যে চাপা আতঙ্কের ছায়া। সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হুঁশিয়ারি—আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। আন্দোলনকারীরা বুঝতে পারছিলেন, আক্রমণ আসন্ন। তবে ঘরে বসে থাকা যায় না। অধিকার আদায়ে সোচ্চার না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে কী জবাব দেওয়া যাবে? বিশেষ করে নারীদের অগ্রগামী ভূমিকা, সাহস যোগাচ্ছিল। একজন নারী যদি সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে আন্দোলনে থাকতে পারেন, তবে কেন একজন পুরুষ পিছিয়ে থাকবে?
সেদিন দুপুর আড়াইটায় শাটল ট্রেনে উঠে আন্দোলনকারীরা। তবে ট্রেন ছাড়ছিল না। বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ল, আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে জোর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগের নেতারা। উদ্দেশ্য—তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল ও আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর মুচলেকা নেওয়া। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল, শাটলে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসেই আন্দোলন গড়ে তোলে। প্রক্টর অফিসের দিকে যাত্রা শুরু। কিন্তু শহীদ মিনারের কাছাকাছি আসতেই অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগ। মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে থাকা একজন আন্দোলনকারী সেদিন মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। তাঁর মাথা ফেটে যায়, সারা শরীর রক্তে ভিজে যায়, ধূসর টি-শার্ট খয়েরি রঙ ধারণ করে। রক্তক্ষরণ থামছিল না। মনে হচ্ছিল, এটাই হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। মাথায় পাঁচটি সেলাই পড়ে। সেই সন্ধ্যায় তাঁর বড় ভাই তাঁকে দেখতে আসেন, এবং পরদিন তাঁকে গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও তিনি শান্তিতে থাকতে পারেননি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে নিয়ে লেখা হলে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের রোষানলে পড়েন। ‘নব্য রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে শাসানো হয়, যে কোনো সময় হামলা বা গ্রেপ্তারের শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কা ছিল। আতঙ্কে রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটেছে, নিজের ঘরে ঘুমাতেও সাহস পাননি। তবু থেমে থাকেননি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আবারও আন্দোলনে অংশ নেন। মৃত্যুর ভয় কেটে গিয়েছিল।
৫ আগস্ট, আন্দোলনের শেষ দিন, সমস্ত কষ্ট যেন মুহূর্তেই লাঘব হয়ে যায়। রক্তে ভেজা সেই টি-শার্ট আজও তিনি স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে রেখে দিয়েছেন, যেন পরবর্তী প্রজন্মকে বলতে পারেন—তাঁর পূর্বপুরুষ কাপুরুষ ছিল না। সেই টি-শার্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আজীবন তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।