ঢাকা, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দপ্তরে ঘটে যাওয়া নারকীয় বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনের নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘদিন পর মুখ খুলেছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ। এ ঘটনায় সরকার ও সামরিক বাহিনীর তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এক দীর্ঘ ভিডিও বার্তায় মইন ইউ আহমেদ এসব তথ্য তুলে ধরেন।
বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট ও সামরিক গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা
মইন ইউ আহমেদ বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে যখন তিনি প্রতিদিনের মতো সেনাসদরে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন সিজিএস (চিফ অব জেনারেল স্টাফ) লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিনহা এসে তাকে কিছু মর্টার সরঞ্জাম সম্পর্কে জানান। তিনি বলেন, এই মর্টারগুলো সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নয় এবং এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন। বিডিআর এগুলো ব্যবহার করতে পারে। বিডিআরের ডিজি জেনারেল শাকিলের সঙ্গে কথা বলে মইন ইউ আহমেদ তাকে মর্টারগুলো নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে তখন পর্যন্ত জেনারেল শাকিলও বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছু জানতেন না বলে মনে করেন মইন ইউ আহমেদ।
বিদ্রোহের শুরুর মুহূর্ত
মইন ইউ আহমেদ বলেন, ৯টায় মিটিং শুরু হলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তার প্রিন্সিপল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ এসে জানান, পিলখানায় গণ্ডগোল হচ্ছে এবং তার দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। সেনাসদরের সামরিক গোয়েন্দারা বিদ্রোহের প্রকৃতি সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে তিনি আরেকটি ব্রিগেডকে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেন, যা ‘অপারেশন রেস্টোর অর্ডার’ নামে পরিচিত হয়।
বিদ্রোহের সময়ের অবস্থা
তিনি বলেন, সকাল ৯টা ৪৭ মিনিটে তিনি বিডিআরের ডিজি জেনারেল শাকিলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন। শাকিল তাকে জানান, দরবার চলাকালীন সময়ে কিছু সশস্ত্র সৈনিক দরবার হলে প্রবেশ করে এবং বাইরে থেকে গুলির শব্দ শুনে তারা বেরিয়ে যায়। বিদ্রোহ পরিকল্পিত ছিল বলে মনে করেন মইন ইউ আহমেদ। তিনি জানান, শাকিল সেক্টর কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও বিদ্রোহীরা পালিয়ে যায়।
সরকারের ভূমিকা ও সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি
মইন ইউ আহমেদ বলেন, সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিগেডের প্রস্তুতির কথা জানান এবং পিলখানায় যাওয়ার অনুমতি চান। সরকার তখন জানিয়েছিল যে, তারা রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে এবং সেনাবাহিনীকে এলাকা ত্যাগ করতে হবে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা ও সমালোচনা
মইন ইউ আহমেদ বলেন, বিদ্রোহের সময় গণমাধ্যমে চলমান লাইভ কাভারেজ বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছালেও তারা পরিস্থিতি মোকাবিলার অনুমতি পাননি। অনুমতি পেলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না বলে মত দেন মইন ইউ আহমেদ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ও অভিযানের উদ্যোগ
মইন ইউ আহমেদ বলেন, বিদ্রোহীরা পিলখানার গেটগুলোর সামনে রকেট লঞ্চার, মর্টারসহ অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করে এবং ৪৬ ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি মেইন গেটের কাছাকাছি পৌঁছালে তারা রকেট হামলা চালায়। এতে একজন চালক নিহত হন এবং সেনা কর্মকর্তাদের ওপরও হামলা করা হয়। বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার কথা জানানো হয়।
বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ ও সাধারণ ক্ষমার আলোচনা
মইন ইউ আহমেদ জানান, বিদ্রোহীদের একটি দল যমুনাতে এসে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাধারণ ক্ষমা চায়। প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বলেন। তবে মইন ইউ আহমেদ স্পষ্ট করে বলেন, বিদ্রোহীদের কোনো দাবি মানা যাবে না এবং তাদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিদ্রোহীদের প্রথমত, অফিসার হত্যা বন্ধ করতে হবে, দ্বিতীয়ত, আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে এবং তৃতীয়ত, অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে হবে।
ভবিষ্যত তদন্তের আহ্বান
ভিডিও বার্তায় মইন ইউ আহমেদ বিডিআর বিদ্রোহের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন এবং সরকারের প্রতি এ বিষয়ে পুনঃতদন্তের আহ্বান জানান। তিনি আরও জানান, বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা একটি বই শিগগিরই প্রকাশিত হবে, যেখানে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে।