রাজবাড়ী থেকে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্প:
রাজবাড়ী থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ ও পুরোনো লাইন সংস্কারে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছিল, যেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল দিনে ১৪টি ট্রেন চলাচলের। তবে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করার পর বর্তমানে মাত্র দুটি ট্রেন চলাচল করছে। এটি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নির্মিত আটটি রেললাইনের মধ্যে অন্যতম, যেগুলো সক্ষমতার তুলনায় কম ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় শুরুতে ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা, যা পরে ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।
‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের তালিকা:
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্মিত আটটি রেললাইন প্রকল্পের মধ্যে পাবনা–ঢালারচর, কুমিল্লার লাকসাম–চিনকি আস্তানা, চট্টগ্রামের দোহাজারী–কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া–কুমিল্লার লাকসাম, খুলনা–মোংলা, আখাউড়া–আগরতলা, এবং পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পগুলো উল্লেখযোগ্য। এসব প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ৭১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা হলেও, এগুলোর সুফল প্রায় অপ্রতুল। ফলে এসব রেললাইন প্রকল্পগুলোকে ‘সাদা হাতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, অর্থাৎ প্রচুর ব্যয় হলেও সেগুলোর থেকে আশানুরূপ লাভ পাওয়া যায়নি।
প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি:
এই আটটি রেললাইন প্রকল্পের ছয়টি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দ্বারা বাস্তবায়িত হয়েছে, এবং বাকিগুলো ভারতীয় ও বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স গ্রুপ বেশি কাজ পেয়েছে। এসব প্রকল্পের কোনোটি রাজনৈতিক বিবেচনায়, কোনোটি অর্থায়নকারী দেশের পরামর্শে, এবং কোনোটি ঠিকাদারদের তৎপরতায় বাস্তবায়িত হয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, তমা কনস্ট্রাকশন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে ঘনিষ্ঠতার কারণে বেশি কাজ পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পাবনা–ঢালারচর রেললাইন:
পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ঢালারচর পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পের ব্যয় শুরুতে ধরা হয়েছিল ৯৮৩ কোটি টাকা, যা পরে ১ হাজার ৭১৫ কোটি টাকায় পৌঁছায়। প্রকল্পটি নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা না করেই নেওয়া হয়েছিল, এবং উদ্বোধনের পর দুই বছর পর্যন্ত কোনো ট্রেন চালানো হয়নি।
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ:
পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে, যার মোট ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই প্রকল্পে শুরুতে প্রতিদিন ৪৮টি ট্রেন চালানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বর্তমানে মাত্র ১০টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেললাইন:
দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে বড় ধরনের পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা ছিল, তবে বর্তমানে মাত্র দুটি ট্রেন চলাচল করছে এবং সেটাও অনিয়মিত।
খুলনা–মোংলা ও আখাউড়া–আগরতলা রেললাইন:
ভারতীয় ঋণে নির্মিত খুলনা–মোংলা ও আখাউড়া–আগরতলা রেলপথের প্রকল্প দুটি দীর্ঘ সময় পর বাস্তবায়িত হয়েছে। যদিও খুলনা-মোংলা পথে একটি ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে, আখাউড়া–আগরতলা রুটে এখনো কোনো ট্রেন চালানো হয়নি।
বিশ্লেষণ ও পরবর্তী পদক্ষেপ:
বিশ্লেষকদের মতে, এসব প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ও জনকল্যাণে কতটা ভূমিকা রাখবে তা সঠিকভাবে যাচাই না করেই এগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, এবং ভবিষ্যতে এসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।
উপসংহার:
২০১৮ থেকে ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ে ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে, যা এই বিশাল বিনিয়োগের পরিণতির একটি অংশ। এটি প্রমাণ করে যে, এসব প্রকল্পের প্রাথমিক লক্ষ্য এবং বাস্তবিক সফলতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকেই যায়।