দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত নতুন রেল সেতুর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। আগের নাম ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেল সেতু’ পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘যমুনা রেল সেতু’।
রোববার (২২ ডিসেম্বর) রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই নাম পরিবর্তনের ঘোষণা আসে। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন জানান, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে এই সেতু উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রাথমিকভাবে জাতির জনকের নামে এই সেতুর নামকরণ করা হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন করে ‘যমুনা রেল সেতু’ নামটি চূড়ান্ত করেছে। এ বিষয়ে কর্মকর্তারা জানান, স্থানীয় জনগণের চাহিদা ও ভৌগোলিক পরিচিতিকে গুরুত্ব দিয়েই এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, “নাম পরিবর্তনের পরও সেতুটির গুরুত্ব অপরিবর্তিত থাকছে। এটি দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সংযোগের জন্য একটি যুগান্তকারী উন্নয়ন প্রকল্প।”
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রেল যোগাযোগের চাহিদা মেটাতে ২০২০ সালের ৩ মার্চ সেতুটির পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। প্রাথমিকভাবে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর সমান্তরালে এই রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়।
প্রকল্পের প্রাথমিক বাজেট ছিল ৯,৭৩৪ কোটি টাকা। তবে নির্মাণকাজ চলাকালীন সময়ে সময়সীমা এবং ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দুই বছর সময় বাড়ানোর পর ব্যয় দাঁড়ায় ১৬,৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪,৬৩১ কোটি টাকা সরকারের পক্ষ থেকে এবং ১২,১৪৯ কোটি টাকা জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা (JICA) অর্থায়ন করেছে।
নতুন এই রেল সেতুটি ৪.৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এটি ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাক (বহুমুখী লাইনের সুবিধা) প্রযুক্তিতে নির্মিত হয়েছে। এর ফলে একই সময়ে মিটারগেজ এবং ব্রডগেজ ট্রেন চলাচল করতে পারবে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় নতুন সেতুটি অনেক বেশি ভারবহন ক্ষমতা সম্পন্ন এবং প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত।
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে রেল চলাচলের সময় নানান সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়।
গতি সীমা: বঙ্গবন্ধু সেতুর রেল সংযোগে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার।
ওজন সীমাবদ্ধতা: এই রেল সংযোগে সর্বোচ্চ ৪৩.৭০ কিলো-নিউটন/মিটার ওজন বহন করা যায়।
সিগন্যাল সমস্যায় দেরি: এক লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে ট্রেনগুলোকে প্রায় ২৫ মিনিট সময় নিয়ে সেতু পাড়ি দিতে হয় এবং সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
যমুনা রেল সেতু চালু হলে এই সমস্যাগুলো দূর হবে এবং ট্রেন চলাচল আরও দ্রুত ও নিরাপদ হবে।
প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের মধ্যে পাবনাবাসী অন্যতম। বর্তমান রেলওয়ে ব্যবস্থাপনায় ইঞ্জিনের সংকট থাকলেও, পাবনাবাসীর দাবির মুখে নতুন ট্রেন চালুর বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধে পাবনাবাসীর জন্য নতুন ট্রেন চালুর বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।”
এই সেতুটি ভূমিকম্পসহনশীল প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়েছে এবং এতে আধুনিক রেল ট্র্যাক স্থাপন করা হয়েছে।
সেতুর কাঠামোতে স্মার্ট সেন্সর বসানো হয়েছে, যা রেল চলাচলের সময় ট্র্যাকের অবস্থার ওপর নজরদারি করবে।
দুর্যোগ মোকাবেলা সক্ষমতা: সেতুটি ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প সহ্য করতে পারবে।
বিস্তারিত পরীক্ষা: প্রতিটি অংশের নির্মাণকাজ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষা করা হয়েছে।
স্থানীয় জনগণ এই সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় দিন গুনছে। নাম পরিবর্তনের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও সেতুটি তাদের অর্থনৈতিক এবং পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধি করবে বলে আশাবাদী।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “নাম যাই হোক, এই সেতু আমাদের জন্য আশীর্বাদ। এখন ঢাকা যাওয়া আরও সহজ হবে এবং কৃষিপণ্য পরিবহন সহজ হবে।”
অন্যদিকে, জাতির জনকের নামে নামকরণ বাতিল হওয়ায় অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেছেন। এক শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নামে নাম থাকলে আরও গর্ববোধ করতাম। তবে নাম নয়, কাজটাই বড় কথা।”
এই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ব্যয় বৃদ্ধি এবং সময়সীমা অতিক্রম করা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি রেলওয়ে ব্যবস্থাপনায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে এই সেতু।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এতে উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবাহ আরও গতিশীল হবে।
নাম পরিবর্তন নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও যমুনা রেল সেতু দেশের উন্নয়ন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। দেশের উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে দ্রুত ও নিরাপদ যোগাযোগ স্থাপন করে এটি শিল্প, বাণিজ্য এবং কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাবে।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগে প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন যুগের সূচনা হবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।