নিজস্ব প্রতিবেদক-
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং উদীয়মান সুপারপাওয়ার হিসেবে ভারত দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির উগ্র হিন্দুত্ববাদী নীতিমালা ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর প্রতি অসম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক বন্ধু হারাচ্ছে ভারত। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দিল্লির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির বাস্তবায়ন ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় কোনো প্রতিবেশী দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক এখন মসৃণ নয়।
পাকিস্তানের সঙ্গে শত্রুতার ভয়াবহ রূপ
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক সবসময়ই বৈরী। ২০১৯ সালের পুলওয়ামা সন্ত্রাসী হামলার পর এই শত্রুতা আরও তীব্র হয়। হামলার পর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) সম্মেলন স্থগিত হয় এবং সম্পর্কের উন্নতির জন্য নেওয়া নানা উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পথে দুই দেশের দ্বন্দ্ব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মালদ্বীপে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ইস্যু
মালদ্বীপের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতবিরোধী ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজু ভারতীয় সেনাদের মালদ্বীপ থেকে প্রত্যাহারের আল্টিমেটাম দেন, যা পরবর্তীতে ভারত মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাটি আঞ্চলিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাবশালী অবস্থানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে উত্তেজনা
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব কাটচাথিভু দ্বীপ নিয়ে। ১৯৭০-এর দশকে দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে হস্তান্তর করলেও এটি এখনো দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার বিষয়। এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কায় চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ভারতকে আরও অস্বস্তিতে ফেলেছে। শ্রীলঙ্কা ও চীনের সম্পর্ক জোরালো হওয়ায় ভারতের আঞ্চলিক কৌশল অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
নেপাল ও ভুটানের দূরত্ব
নেপাল দীর্ঘদিন ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দু’দেশের সম্পর্ক অবনতির দিকে গেছে। ভারতের সঙ্গে নেপালের বাণিজ্য নির্ভরতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নেপালকে চীনের বলয়ে ঠেলে দিচ্ছে। একইভাবে, ভুটানও ক্রমশ ভারতের প্রভাব থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিকদের মন্তব্য বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ করেছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে অপপ্রচার এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগে ভারতবিরোধী ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ভারতের জন্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় আরও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
মিয়ানমার ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠী
মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক জটিলতার মধ্যে রয়েছে। ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটে ভারতের সীমিত ভূমিকা এবং চীনের প্রভাব আরও বাড়ছে, যা ভারতের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করছে।
‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির ব্যর্থতা
বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদি সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতিমালা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে ভারত তার আঞ্চলিক প্রভাব হারাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশ ভারতের দাদাগিরি ও অসম্মানজনক আচরণে ক্ষুব্ধ। ফলে চীন ক্রমশ দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগজনক।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ক্রমাগত দূরত্ব মোদি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতাকেই স্পষ্ট করছে। দাদাগিরি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করে যদি দিল্লি আন্তরিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে, তবে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান আরও দুর্বল হতে পারে।