টিসিবির ট্রাক সেলে নিত্যপণ্য কিনতে দীর্ঘ লাইন আর বিশৃঙ্খলার কারণে অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরছেন। নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের চাপে স্বল্প ও মধ্যবিত্তরা সাশ্রয়ের আশায় এসব লাইনে ভিড় করছেন। তবে পণ্যের অপ্রতুলতার কারণে বেশিরভাগ স্থানে দেখা যাচ্ছে হতাশা আর ক্ষোভ।
সীমিত সরবরাহ, দীর্ঘ অপেক্ষাঃ
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, টিসিবির ট্রাকের পেছনে অন্তত ৫০-১০০ জন মানুষ প্রতিদিন পণ্য না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য বরাদ্দ থাকলেও অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা প্রায়ই তা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
মহাখালীর ওয়্যারলেস গেইটে লাইনে দাঁড়ানো জহিরুল ইসলাম বললেন, “ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কিছুই পাইনি। লাইন ভেঙে অন্যরা নিয়ে গেছে, অথচ আমরা খালি হাতে ফিরেছি।”
একইভাবে তিতুমীর কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে নাসিমা বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করেন, “লাইনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। মালামাল কম থাকায় মানুষ নিয়ম মানতে চায় না।”
দীর্ঘ লাইন, কম পণ্য
টিসিবি জানিয়েছে, রাজধানীর ৫০টি স্থানে ট্রাক থেকে পণ্য বিক্রি করা হয়। প্রতিটি ট্রাকে সাড়ে ৩৫০ পরিবারের জন্য বরাদ্দ থাকে। তবে বাস্তবে মহাখালী, শাহবাগ, মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে, প্রায় ৫০ থেকে ১০০ জন অতিরিক্ত মানুষ লাইনে অপেক্ষা করছেন।
খিলগাঁও এলাকায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পণ্য পেয়ে ষাটোর্ধ্ব জাফর আহমেদ বললেন, “এত লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মনে হলো যেন জীবনযুদ্ধে জয় করলাম।”
গৃহকর্মী শাহানাজ বেগম বলেন, “যদি সরকার পণ্যের সরবরাহ আরও বাড়াত, তাহলে আমাদের সুবিধা হতো। বাজারের দামও যদি একটু কমত, তাহলে আর লাইনে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হতো না।”
সাশ্রয়ের আশায় মধ্যবিত্তও লাইনে
মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্তরাও এখন টিসিবির ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। মতিঝিলের বক চত্বরে দাঁড়িয়ে বেসরকারি চাকরিজীবী আফতাব আহমেদ বলেন, “আগে কখনো লাইনে দাঁড়াইনি। কিন্তু এখন জিনিসপত্রের এত দাম যে বাধ্য হয়েই দাঁড়াচ্ছি।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবরে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলছেন, “মানুষের আয় বাড়েনি। কিন্তু কেনার ক্ষমতা কমে গেছে। এজন্য সাশ্রয়ের জন্য মানুষ টিসিবির ট্রাক সেলের দিকে ঝুঁকছে।”
সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা
টিসিবির যুগ্ম পরিচালক হুমায়ুন কবির জানান, প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য বরাদ্দ। এর বেশি মানুষের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পণ্য সরবরাহ সম্ভব নয়। তবে সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাণিজ্য সচিব সেলিম উদ্দিন বলেন, “টিসিবির প্রতিটি ট্রাকে পণ্য বরাদ্দ ৩৫০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি ট্রাক সেলের স্পট এবং মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়েও কাজ করা হচ্ছে। আমরা ট্রাক সেলের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছি।”
সমাধানের পথে তাকিয়ে মানুষ
খুচরা বাজারে যেখানে নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, সেখানে টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে প্রায় ৪৫০ টাকা সাশ্রয় হয়। ফলে মানুষের ভিড় বাড়ছেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নয়ন ছাড়া মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা কঠিন হবে। একইসঙ্গে নীতিগত পরিকল্পনায় ট্রাক সেলের ব্যবস্থাপনা আরও সুশৃঙ্খল ও কার্যকর করার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
মানুষের প্রয়োজন মেটাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হলে এই দীর্ঘ লাইন আর বিশৃঙ্খলা হয়ত কিছুটা কমবে। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতি উন্নয়ন ছাড়া মানুষের দুশ্চিন্তা আর দুর্ভোগ কাটানোর পথ সুগম হবে না।