স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার কার্যক্রমে শৃঙ্খলা আনা এবং জনগণের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ) হাসপাতালে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাসহ ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ১৮ নভেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব উম্মে হাবিবার স্বাক্ষরিত এই নির্দেশনা দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নির্দেশনা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য হল সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের সেবার মানোন্নয়ন, বিশেষ করে চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, ভিজিটর কার্ড চালু, হাসপাতালের ভেতরে শৃঙ্খলা রক্ষা এবং রিসিপশন ডেস্ক স্থাপনসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নির্দেশনায় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আহত ছাত্র-জনতাসহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সব আহত রোগীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় হাসপাতালে আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে হবে।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনো ব্যক্তি যদি চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ হন, তবে তার চিকিৎসার ওষুধের খরচ সরকার বহন করবে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিল ও ভাউচার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দাখিল করতে হবে, যা যাচাই-বাছাইয়ের পর পরিশোধ করা হবে।
চিকিৎসাধীন আহতদের মধ্যে যদি কারও উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, এবং সেই চিকিৎসা দেশে সম্ভব না হয়, তবে মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশক্রমে তাকে বিদেশে পাঠানো যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য ও কাগজপত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে।
নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি বা ডিলার হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন না। চিকিৎসাসেবায় মনোযোগ ধরে রাখতে এবং রোগীদের সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কারণ হাসপাতালের পরিবেশে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের উপস্থিতি প্রায়ই রোগীর সেবা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলে চিকিৎসা কার্যক্রমে গতি আসবে এবং রোগীর সেবা পাওয়ার সময় কমবে।
হাসপাতালে আগত দর্শনার্থীদের জন্য ভিজিটর কার্ড চালু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো দর্শনার্থী ভিজিটর কার্ড ছাড়া রোগীর কক্ষে প্রবেশ বা অবস্থান করতে পারবেন না। এ নিয়মের মাধ্যমে রোগীদের বিশ্রামের সময় নিশ্চিত করা এবং হাসপাতালের নিরাপত্তা জোরদার করা সম্ভব হবে।
প্রতিটি হাসপাতালে রিসিপশন ডেস্ক স্থাপন করে রোগীদের সেবার ধরন অনুযায়ী বাছাই করে চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। অভ্যর্থনা কক্ষ সেবাপ্রার্থীদের দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা পেতে সহায়ক হবে।
হাসপাতালে টিকিট কেনার বিষয়টি সুশৃঙ্খল করতে ডিজিটাল টিকিটিং ব্যবস্থার প্রবর্তনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থার ফলে রোগীদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না এবং সময় সাশ্রয় হবে।
নির্দেশনায় স্পষ্ট করা হয়েছে, কোনো হাসপাতালে নিবন্ধিত বা সার্টিফায়েড নয় এমন কোনো ব্যক্তি চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। এটি চিকিৎসাসেবার মান উন্নত করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবাইকে রোগী দেখার সময়সূচি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়সূচি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। এতে রোগীদের অপেক্ষার সময় কমবে এবং সেবার কার্যক্রমে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপ সময়োপযোগী এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা খাতের বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো হাসপাতালের ভেতরের শৃঙ্খলার অভাব, অপ্রয়োজনীয় দর্শনার্থীর ভিড় এবং ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের প্রভাব।
এছাড়া, আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করাও সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এই উদ্যোগের ফলে চিকিৎসা খাতে জনগণের আস্থা বাড়বে এবং হাসপাতালের সেবার মান উন্নত হবে।
নির্দেশনাগুলো কার্যকর করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারি করা এই ১০ নির্দেশনা চিকিৎসা খাতে শৃঙ্খলা আনতে এবং সেবার মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। নির্দেশনাগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের আন্তরিকতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে আরও উন্নত ও সুশৃঙ্খল করতে একটি বড় পদক্ষেপ।