ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি সবুজ প্রকৃতির জন্য পরিচিত, সেখানে এক ভিন্নরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রবিবার (১৭ নভেম্বর) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হঠাৎ শিয়ালের আক্রমণে তিনজন আহত হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে আছেন ভূতাত্ত্বিক বিভাগের এক শিক্ষার্থী, এক নিরাপত্তা প্রহরী এবং এক দোকানদার। আহতদের দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং পরে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়।
আহতদের মধ্যে ভূতাত্ত্বিক বিভাগের শিক্ষার্থী মো. শাহারিয়ার, নিরাপত্তা প্রহরী অজয় হালদার এবং ক্যাম্পাসের দোকানদার আবদুল জব্বার রয়েছেন। আহত আনসার সদস্য অজয় হালদার বলেন, “রাস্তা ধরে হাঁটার সময় হঠাৎ জঙ্গল থেকে একটি শিয়াল বেরিয়ে আমার পায়ে কামড় বসায়। তখন আমার সঙ্গে আরও দুইজন ছিল। শিয়ালটিকে আঘাত করলে সেটি আবার জঙ্গলে চলে যায়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তা ডা. শামসুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, “আহতদের মধ্যে দোকানদার আবদুল জব্বারের শারীরিক অবস্থা সবচেয়ে গুরুতর। তার মুখ, হাত, এবং পায়ে শিয়ালের কামড়ের দাগ রয়েছে। তাকে দ্রুত টিকা নিতে হবে।” চিকিৎসকদের ধারণা, শিয়ালটি র্যাবিস (জলাতঙ্ক) ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল, যা প্রাণীটির অস্বাভাবিক আচরণের কারণ হতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের টারজান এলাকায় শিয়ালের আক্রমণ সবচেয়ে তীব্র আকার ধারণ করেছে। দোকানদার আবদুল জব্বার জানান, “আমি দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে শিয়ালটি আক্রমণ করে। আমি চিৎকার করলে আশেপাশের লোকজন ছুটে আসে এবং শিয়ালটি পালিয়ে যায়। তবে আক্রমণের ফলে আমার হাত ও মুখে গুরুতর আঘাত পেয়েছি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, “আমাদের ধারণা, শিয়ালটি র্যাবিসে আক্রান্ত হতে পারে। এ কারণে প্রাণীটি পাগলাটে আচরণ করছে এবং সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই আক্রমণ করছে। যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে ক্যাম্পাসের আরও মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের র্যাবিস আক্রান্ত প্রাণীকে দ্রুত হত্যা করে মাটির নিচে পুঁতে ফেলা উচিত, যাতে ভাইরাসটি ছড়াতে না পারে। এছাড়া, যারা ইতিমধ্যে আহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে দ্রুত জলাতঙ্কের টিকা নিতে হবে।”
এই ঘটনা শিক্ষার্থী এবং ক্যাম্পাসবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাসনিম বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সবসময়ই নিরাপদ মনে হতো। কিন্তু এখন আমরা রাতে চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছি। প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।”
ক্যাম্পাসে বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যেই শিয়ালের উপস্থিতি দেখা গেছে। শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রশাসন শিয়ালগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে এমন আক্রমণ আরও বাড়তে পারে।
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিভাগ ক্যাম্পাসে বিশেষ নজরদারি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শিয়ালের আক্রমণ বন্ধ করতে শীঘ্রই একটি জরুরি বৈঠক ডাকা হবে। প্রশাসন ইতিমধ্যে প্রাণী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং শিয়ালগুলোকে ধরা ও নিরাপদে সরানোর পরিকল্পনা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মিজানুর রহমান জানান, “আমরা ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করছি। শিয়ালের আক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হবে। এছাড়া, আহতদের চিকিৎসার জন্য আমরা সার্বিক সহায়তা প্রদান করছি।”
শিয়ালের আক্রমণের ঘটনার পর ক্যাম্পাসে একটি নৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। একদিকে, ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণীদের উপস্থিতি সংরক্ষণের দাবি রয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থী ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি।
প্রাণী অধিকার কর্মী তানভীর হাসান বলেন, “শিয়াল একটি সংরক্ষিত প্রাণী। কিন্তু যদি সেটি র্যাবিসে আক্রান্ত হয়, তাহলে মানুষের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে সেটি যেন প্রাণীটির প্রতি অমানবিক না হয়।”
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিয়ালের আক্রমণ প্রতিরোধে কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্যাম্পাসে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রাণীদের আচরণ পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনে শিয়ালগুলোকে অন্যত্র স্থানান্তর করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এ ধরনের পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। র্যাবিস আক্রান্ত প্রাণী চিনতে পারা এবং দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিয়ালের আক্রমণ একটি নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। একদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা, অন্যদিকে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই দ্বন্দ্ব সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। প্রশাসন এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত উদ্যোগই এই সংকট সমাধানে সহায়ক হতে পারে।