গণআন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকারকে বিদায় জানিয়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে আজ থেকে ১০০ দিন আগে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই সরকার গঠন করা হয়, যার প্রতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল অত্যন্ত উচ্চ। দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই সরকার। তবে তিন মাস পার হলেও, সরকারের অনেক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি চোখে পড়ছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেছেন, ‘‘বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তিন মাস সময় যথেষ্ট না হলেও অগ্রগতি দেখানোর জন্য একেবারে কমও নয়।’’ সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল যে, অন্তর্বর্তী সরকার দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরতে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু বাস্তবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্দোলন ও বিক্ষোভের চাপের মধ্যেও তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘আমরা সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যে আমাদের প্রচেষ্টার দৃশ্যমান ফলাফল দেখতে পাবেন সাধারণ জনগণ।’’
তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার চিন্তাও জানিয়েছে সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘জনস্বার্থের বিপরীতমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে হয়েছে। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গড়তে চাই যেখানে জনগণই হবে সকল ক্ষমতার উৎস।’’ তরুণ প্রজন্ম ও ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের অঙ্গীকার করেন তিনি।
সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মাথায় ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। এই কমিশনগুলো সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। পরবর্তীতে আরও চারটি কমিশন গঠন করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার, ও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
কমিশনগুলো ইতোমধ্যেই বিভিন্ন খাতে জরিপ ও বিশ্লেষণ কাজ শুরু করেছে। ডিসেম্বরের শেষে তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো থেকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা শোনা যাচ্ছে, বিশেষত প্রশাসনিক সংস্কারে বিদ্যমান দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি প্রধান লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা এখনও সফল হয়নি। একাধিক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকারের কাছে সময় খুবই সীমিত এবং দ্রুত কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ না করলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করাও সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনলে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা ফিরে পাওয়া কঠিন হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন।
সরকার গঠনের পর থেকেই ড. ইউনূস জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, দ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশন ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছে এবং একটি নতুন নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরির চেষ্টা চলছে। তবে, এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নের পথে নানা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছিল। সরকারের প্রতিশ্রুতির ওপর বিশ্বাস রেখে তারা পরিবর্তনের প্রত্যাশা করেছিল। তবে, তিন মাস পর এসে অনেক তরুণই হতাশা প্রকাশ করছে। তাদের মতে, প্রশাসনিক দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এখনও সমাজের প্রতিটি স্তরে বিরাজমান।
তরুণদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাস্তবে এই পরিবর্তনের গতি অত্যন্ত ধীর। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তরুণদের আস্থা ধরে রাখতে হলে সরকারকে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
১০০ দিন পূর্ণ করে অন্তর্বর্তী সরকার এখনও জনগণের আস্থা ধরে রাখতে চেষ্টা করছে। তবে, প্রতিশ্রুতি পূরণে ধীরগতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী কয়েক মাস সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নতি করতে পারে, তবে আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন প্রয়োজন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের। অন্যথায়, আন্দোলন ও বিক্ষোভের মুখে তাদের অবস্থানও টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আগামী তিন মাসের মধ্যেই সরকারের প্রকৃত কার্যক্রমের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে উঠবে।