বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি দিন দিন জটিলতর হচ্ছে। সমুদ্রপথে প্রবেশাধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদ, ও কৌশলগত অবস্থানকে ঘিরে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থ ক্রমশ সংঘর্ষের দিকে এগোচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যে, বঙ্গোপসাগরের পরিস্থিতি শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্যই গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে।
রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৪’ উপলক্ষে দেওয়া বক্তব্যে তৌহিদ হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সংকট একটি বড় ইস্যু। গত আট বছরে এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আশানুরূপ সহযোগিতা পায়নি। তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘প্রতিবেশীদের কাছে আমরা সাহায্য প্রত্যাশা করেছিলাম, কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থের দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। ফলে এই সংকট আমাদের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা সংকট যদি সমাধান না হয়, তাহলে তা শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে না, বরং তা ছড়িয়ে পড়বে অন্যান্য অঞ্চলেও। এতে করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।’’
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, কেন চীন বাংলাদেশকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছে না। এর জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে চীনের জন্য মিয়ানমার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’ মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে উঠেছে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প এবং পাইপলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। তাই বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সংকটে সরাসরি সমর্থন করতে চীন তেমন আগ্রহ দেখায়নি।
এদিকে, ভারতও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে বেশ সচেতন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রবেশাধিকারের জন্য রাখাইন রাজ্যের কালাদান প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘‘ভারত তার স্বার্থ রক্ষা করতে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখতে বাধ্য।’’ এর ফলে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রত্যাশিত সমর্থন পায়নি।
বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রও এখানে বিশেষভাবে মনোযোগ দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক প্রভাবকে প্রতিরোধ করতে চায়। সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং নৌবহরের তৎপরতা বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন, ‘‘আমাদের দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের আরও কিছুটা ধৈর্যের প্রয়োজন। প্রতিটি পরিবর্তনেই সময় লাগে।’’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, ধৈর্য ধারণ করলে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এবং রাজনীতিবিদরা একসঙ্গে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা কি আসলেই কিছু অর্জন করিনি? এখন দেশের ভেতরে যেকোনো সমালোচনা অবাধে করা হচ্ছে। এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।’’
সম্মেলনে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর আয়োজনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন বক্তারা মনে করেন, বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে আঞ্চলিক সহযোগিতা অপরিহার্য। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ এবং বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হোর্গে কিরোগার মতামত অনুযায়ী, এ সংকট সমাধানে কেবল বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের জন্য বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু প্রতিবেশীদের স্বার্থ কেন্দ্রিক জটিলতা ও আঞ্চলিক প্রভাবশালী শক্তির প্রতিযোগিতা পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘায়িত হওয়া এবং আঞ্চলিক শক্তির প্রভাব বজায় রাখা, বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এজন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করাই একমাত্র পথ বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সম্মেলনের আলোচনায় উঠে এসেছে, বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতিতে টেকসই সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে কৌশলী হতে হবে এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। কেবলমাত্র পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।