ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা মানবিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, এবং সামাজিক সুশৃঙ্খলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে। একজন প্রকৃত মুমিনের জন্য ইসলামের শিক্ষা হলো—সে সবসময় অন্যের উপকার করবে এবং কোনো অবস্থাতেই অন্যের ক্ষতিসাধন করবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে, যে ব্যক্তি অন্যের অধিকার নষ্ট করে বা অন্যকে কষ্ট দেয়, সে প্রকৃত মুমিন নয়। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, যারা মানুষের হক নষ্ট করে, আল্লাহ তাদের সাময়িকভাবে মাফ করলেও, আখিরাতে তাদের শাস্তি অবধারিত।
পবিত্র কুরআন বারংবার মানুষকে সতর্ক করেছে অন্যের অধিকার লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন:
“তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পদের কিয়দংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকের কাছে পেশ করো না।” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৮)
এ আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যে, ইসলাম অন্যের সম্পদ ও অধিকারকে সম্মান করতে বাধ্য করে। কেউ যদি অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ গ্রহণ করে, তবে তা হারাম হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতকে তার মালিকের কাছে প্রত্যর্পণ কর।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৫৮)
এই আয়াতের মর্মার্থ হলো, একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো কোনো আমানত তার কাছে থাকলে তা যথাযথভাবে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হাদিসসমূহেও অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা এবং তাদের কষ্ট দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। হজরত আবু সিরমা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি অন্য কারও ক্ষতিসাধন করে, আল্লাহতায়ালা তা দিয়েই তার ক্ষতিসাধন করেন। যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয়, আল্লাহতায়ালা তাকে কষ্টের মধ্যে ফেলেন।” (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৪০)
এই হাদিসের শিক্ষা হলো, দুনিয়াতে যেভাবে আমরা অন্যের সাথে আচরণ করি, আল্লাহ আমাদের সেভাবেই প্রতিদান দেবেন। অন্যের ক্ষতি করলে আখিরাতে আমাদেরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
“যার কাছে তার ভাইয়ের হক রয়েছে, তা মান-সম্মানের হোক বা অন্য কিছুর হোক, সে যেন আজই ক্ষমা চেয়ে নেয় বা (পরিশোধ করে মিটমাট করে নেয়)। এমন দিন আসার আগেই, যেদিন কোনো অর্থকড়ি থাকবে না। যদি ব্যক্তির কোনো নেক আমল থাকে তা দিয়ে পাওনাদারের ঋণ বা হক শোধ করা হবে।” (সহিহ বুখারি)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, দুনিয়াতে যেসব অন্যায় ও হক নষ্ট করা হয়েছে, আখিরাতে তার হিসাব নেওয়া হবে। দুনিয়ায় কেউ হয়তো পার পেয়ে যেতে পারে, কিন্তু আখিরাতে আল্লাহর আদালতে কেউই পার পাবে না।
একজন মুমিনের দায়িত্ব হলো সবসময় অন্যের উপকার করা এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা। ইসলামের শিক্ষা অনুসারে, একজন প্রকৃত মুমিন কখনো অন্যের কষ্টের কারণ হতে পারে না। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন:
“তোমরা ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো, আর অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করো।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত-৯০)
এটি স্পষ্ট যে, একজন মুসলমানের জন্য অন্যের হক আদায় করা শুধুমাত্র একটি নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং তা আল্লাহর কাছে এক ধরণের ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে শুধু আখিরাতেই নয়, দুনিয়াতেও যারা অন্যের হক নষ্ট করে, তাদের শাস্তি অনিবার্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“কেউ অন্যের ক্ষতি করলে আল্লাহ তার ক্ষতিসাধন করবেন। কেউ অযৌক্তিকভাবে কারও বিরোধিতা করলে আল্লাহ তার বিরোধী হবেন।” (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬৩৫)
এই হাদিসের শিক্ষা হলো, আল্লাহ সবসময় ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন এবং যারা অন্যায়ভাবে মানুষের ক্ষতি করে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেন।
দুনিয়াতে যারা অন্যের অধিকার লঙ্ঘন করে, আখিরাতে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। নবিজি (সা.) বলেছেন, আখিরাতে কারও অর্থকড়ি থাকবে না যা দিয়ে তারা ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে। বরং তাদের নেক আমল দিয়ে পাওনাদারের হক শোধ করতে হবে। আর যদি কোনো নেক আমল না থাকে, তবে পাওনাদারের পাপ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দুনিয়ার জীবন সাময়িক। আখিরাতের বিচারই হলো চূড়ান্ত বিচার। তাই আমাদের উচিত এখনই অন্যের হক আদায় করা এবং কারও অধিকার নষ্ট না করা।
ইসলামের শিক্ষার মূলনীতি হলো—অন্যের প্রতি ন্যায়পরায়ণতা প্রদর্শন করা এবং সবসময় সত্যের পথে চলা। একজন মুমিনের জন্য অপরের অধিকার রক্ষা করা, তাদের সম্মান করা, এবং কোনো অবস্থাতেই ক্ষতিসাধন না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহতাআলা আমাদের সবাইকে অন্যের হক নষ্ট করা থেকে বিরত থাকার তাওফিক দিন এবং আমাদের সকলকে ন্যায়পরায়ণতা ও সততার পথে পরিচালিত করুন।