ইসলামের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমি। এই ভূমি শুধু পবিত্র ধর্মীয় স্থান নয়, বরং কেয়ামতের পূর্ববর্তী ঘটনাবলীর মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কুরআন ও হাদিসে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও বিভিন্ন হাদিস বর্ণনায় ফিলিস্তিনের গুরুত্ব, ইমাম মাহদির আগমন, দাজ্জাল এবং ঈসা (আ.)-এর পুনরাগমনের কথা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে।
ইসলামের তৃতীয় পবিত্র মসজিদ হিসেবে মসজিদুল আকসা মুসলিমদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সেই স্থান যেখানে মহানবী (সা.) মেরাজে গমনের আগে সকল নবীর ইমাম হিসেবে নামাজ আদায় করেছিলেন। এই মসজিদকে ঘিরেই মুসলিমদের মুক্তি ও শেষ যুগের মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে বলে হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়।
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, ইমাম মাহদি যখন মুসলিমদের নিয়ে মসজিদুল আকসায় আশ্রয় নেবেন, তখন দাজ্জাল বাহিনী মুসলিমদের ঘিরে ফেলে তাদের হত্যা করার চেষ্টা করবে। এসময় মুসলিমরা দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবে। এমন পরিস্থিতিতে হযরত ঈসা (আ.) এর আগমন ঘটবে এবং তিনি মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে মুসলমানদের সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করবেন। এর পরেই তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন।
হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী, কেয়ামতের আগে যখন দুনিয়ায় ফিতনা-ফাসাদ বৃদ্ধি পাবে এবং দাজ্জাল নিজেকে খোদা দাবি করবে, তখন মুসলিমরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। তবে সেই মুহূর্তে হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে অবতীর্ণ হবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ব দিকের সাদা মিনারে দুই ফেরেশতার সাহায্যে নামবেন। এরপর তিনি ফিলিস্তিনে রওনা দেবেন এবং মুসলমানদের নেতৃত্ব দেবেন।
ইমাম মাহদির সঙ্গে মসজিদুল আকসায় একত্রিত হয়ে ঈসা (আ.) মুসলিমদের নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করবেন। নামাজ শেষে তিনি দাজ্জালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন। দাজ্জাল পশ্চিম দিকে পালিয়ে যাবে, তবে ঈসা (আ.) তাকে ফিলিস্তিনের লুদ নামক স্থানে গিয়ে হত্যা করবেন। এই ঘটনাটি ইসলামের শেষ যুগের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২২৪০)
দাজ্জালের পতনের পর পৃথিবীতে শান্তি ফিরবে বলে আশা করা হলেও, হাদিস অনুযায়ী তখন ইয়াজুজ-মাজুজ নামে এক ভয়ংকর জাতির আবির্ভাব ঘটবে। তারা পৃথিবীতে তাণ্ডব শুরু করবে এবং সবকিছু ধ্বংস করে ফেলবে।
ইসলামের বর্ণনায় জানা যায়, ইয়াজুজ-মাজুজের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে হযরত ঈসা (আ.) ও তার অনুসারীরা ফিলিস্তিনের তুর পাহাড়ে আশ্রয় নেবেন। যদিও বর্তমানে ইসরায়েলের একটি পাহাড়ের নামও তুর, তবে বিখ্যাত তুর পাহাড় মিশরে অবস্থিত। এই পাহাড়ে মুসলিমরা আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন। আল্লাহর বিশেষ রহমতে তখন ইয়াজুজ-মাজুজ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং মুসলিমদের জন্য ফিলিস্তিন আবারো নিরাপদ হয়ে উঠবে।
মহানবী (সা.) ফিলিস্তিনকে বিজয়ী মুসলিমদের ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, “আমার উম্মতের একটি দল সত্যের ওপর বিজয়ী থাকবে। শত্রুর মনে তারা পরাক্রমশালী থাকবে এবং কোনো প্রতিপক্ষ তাদের কিছুই করতে পারবে না। আল্লাহর আদেশ তথা কেয়ামত পর্যন্ত তারা এমনই থাকবে।” সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! তারা কোথায় থাকবে?” রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দেন, “তারা বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশে থাকবে।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২৩২০)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, কেয়ামতের আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিন মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমি হিসেবে থাকবে। এখানে মুসলিমদের একটি দল সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করবে এবং বিজয়ী হবে।
বর্তমান বিশ্বে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটপূর্ণ। ফিলিস্তিনি মুসলিমরা দীর্ঘদিন ধরে ইহুদি আগ্রাসনের শিকার হয়ে আসছে। মসজিদুল আকসা বারবার ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার মুখে পড়ছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই পবিত্র ভূমির রক্ষা ও মুক্তির দায়িত্ব প্রতিটি মুসলমানের ওপর অর্পিত হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, ফিলিস্তিনের মুসলিমদের মুক্তি ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম উম্মাহর একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করা উচিত।
ফিলিস্তিনের জনগণ ইহুদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে সংগ্রাম করে আসছে। প্রতিদিনই সেখানে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। মসজিদুল আকসা বারবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্বের উচিত ফিলিস্তিনের মুক্তি ও মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা।
হাদিসের বর্ণনার আলোকে দেখা যায়, ফিলিস্তিন শুধু কেয়ামতের পূর্ববর্তী যুদ্ধক্ষেত্র নয়, বরং মুসলিমদের জন্য মুক্তির পথও বটে। আজকের বিশ্বে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি, যেন ফিলিস্তিনের মানুষদের মুক্তি ও শান্তি নিশ্চিত করা যায়।
ফিলিস্তিনের মুক্তি ও মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে, ফিলিস্তিন হবে কেয়ামতের পূর্ববর্তী সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধভূমি। এটি মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও বিজয়ের প্রতীক হয়ে থাকবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মসজিদুল আকসার রক্ষায় প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব রয়েছে।
ইসলামের শিক্ষা অনুসারে, ফিলিস্তিনের মুসলমানদের মুক্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। মহানবী (সা.)-এর বাণী ও হাদিসের শিক্ষা অনুযায়ী, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।