ড্রামে ভোজ্যতেল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে: স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে বিএসটিআইয়ের নির্দেশ
বাংলাদেশে ড্রামে ভোজ্যতেল সংরক্ষণ ও বিক্রি একটি দীর্ঘদিনের প্রচলিত পদ্ধতি। তবে এই পদ্ধতি জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ায় ভোজ্যতেল ব্যবস্থাপনায় জরুরি পরিবর্তন আনার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম ড্রামে ভোজ্যতেল বিক্রির ক্ষতিকর দিকগুলো উল্লেখ করে বলেন, “ড্রামের ভোজ্যতেল আমাদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।” তিনি আরও বলেন, ড্রামের ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব থাকে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ড্রামে সংরক্ষণের ফলে তেলের গুণগতমান নষ্ট হয়, যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন সরবরাহে ব্যর্থ হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ভিটামিন ‘এ’ আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান। এটির অভাবে শিশুদের অপরিণত জন্ম, রাতকানা, অন্ধত্ব, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যু এবং নারীদের গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়। ড্রামে সংরক্ষিত তেল ব্যবহারের ফলে এই ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়, যা জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে। ফেরদৌস আলম বলেন, “ভোজ্যতেলের রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বোতলজাত তেলে সঠিক মাত্রায় (১৫-৩০ পিপিএম) ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তবে ড্রামে এই সুযোগ না থাকায় জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।”
বিএসটিআই, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক এডভোকেসি সভায় বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক বলেন, দেশে বোতলজাত ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। তবে অস্বাস্থ্যকর ড্রামে সংরক্ষণের কারণে ড্রামের তেলে ভেজাল মিশ্রণ এবং দূষণের ঝুঁকি থাকে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ড্রামে সয়াবিন তেলের পরিবর্তে পাম তেল বা পাম অলিন ব্যবহার করে, যা তেলের মান ও পুষ্টিগুণে ক্ষতি সাধন করে। তেলের ড্রামগুলোর বারবার পুনঃব্যবহারের ফলে জীবাণু দূষণের আশঙ্কা দেখা দেয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক ফেরদৌস আলম জানান, লবণে আয়োডিন সমৃদ্ধকরণে ব্যাপক সফলতা পাওয়া গেছে এবং দেশে গলগন্ড রোগ নিরসন করা সম্ভব হয়েছে। তবে তেল ব্যবস্থাপনায় এখনও বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। খোলা লবণ নিষিদ্ধ হলেও তেলের ক্ষেত্রে খোলা বিক্রির প্রচলন এখনও বিদ্যমান, যা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।
বিএসটিআই থেকে জানানো হয়, শিল্পমন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে ড্রামে খোলা ভোজ্যতেলের বিক্রি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে খোলা সয়াবিন তেল এবং ডিসেম্বরের পর থেকে খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। এ সময়ে বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ভোক্তা পর্যায়ে পুষ্টির মান নিশ্চিতকরণে আরও কঠোর তদারকি চালানো হচ্ছে।
খোলা তেলের ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিরসনে বিএসটিআই, খাদ্য অধিদফতর, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহায়তায় সমন্বিত প্রচেষ্টার কথা বলা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়িক প্রতিনিধি ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ। বিএসটিআইয়ের সিএম উইংয়ের উপ-পরিচালক এস এম আবু সাঈদ এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি মুশতাক হাসান মুহাম্মদ ইফতিখার স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপদ তেলের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করেন।
জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ায়, এডভোকেসি সভায় ভোজ্যতেলের ড্রামে বিক্রি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয় যে, বোতলজাতকরণের মাধ্যমে সঠিক পুষ্টির মান বজায় রাখা সম্ভব হবে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটবে। জনগণের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভোজ্যতেলের খোলা ড্রাম ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়।
ড্রামে ভোজ্যতেল ব্যবহারে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি বাংলাদেশে একটি গুরুতর সমস্যা। ভোক্তা পর্যায়ে ভোজ্যতেলের গুণগতমান বজায় রাখতে এবং দূষণমুক্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য। ড্রামে ভোজ্যতেল সংরক্ষণ এবং বিক্রয় বন্ধ করা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ, যা একটি স্বাস্থ্যকর ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে সহায়ক হবে।