বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইতিবাচক প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে হাত না দিয়ে আমদানির ব্যয় মেটানো যাচ্ছে, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় সহায়ক হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী এই উন্নতিকে দেশের অর্থনীতির জন্য আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন। তিনি জানান, ডলারের দর বাজারমুখী করাসহ নতুন গভর্নরের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তগুলো ভালো ফল দিচ্ছে।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ধারাবাহিক বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। আগস্ট মাসে যেখানে রেমিট্যান্স এসেছে ২২২ কোটি ডলার, সেখানে অক্টোবরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৯ কোটি ডলারে। সরকারের নীতি পরিবর্তন এবং রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা প্রদানই এই ইতিবাচক ধারায় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রবাসী আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার উপর নির্ভর করেই আমদানিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খরচ মেটানো হচ্ছে, ফলে রিজার্ভের উপর তেমন চাপ সৃষ্টি হচ্ছে না। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন কর্মকর্তারা।
বিগত কয়েক মাস আগে ডলার সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমদানি ব্যয়ের জন্য বিপুল পরিমাণ ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ অনেকটাই হ্রাস পায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না থাকায় অর্থনীতির জন্য এটি একটি সংকটজনক পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই সমস্যার সমাধানে বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
নতুন গভর্নর বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে ডলারের বাজারমূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগের প্রথাগত নিয়মের পরিবর্তে বাজারমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এর পাশাপাশি আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ রাখার নির্দেশনাও দেন তিনি। এই পদক্ষেপগুলোর মাধ্যমে ডলার সংকট কিছুটা লাঘব হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে রয়েছে। যদিও এটি আগের বছরের তুলনায় কম, তবে সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপের ফলে এটি স্থিতিশীল আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা জানিয়েছেন, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ থেকে অন্যান্য দায় পরিশোধ না করায় এই সংখ্যা স্থিতিশীল রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য অর্থ সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থপ্রাপ্তি ঘটলে রিজার্ভ আরও বৃদ্ধি পাবে। এটি ভবিষ্যতের যে কোনো আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে শক্তিশালী অবস্থানে রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রবাসী আয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই ধারা বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী মনে করেন, ডলারের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এবং বাজারমুখী নীতিগুলি দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার মজুদ রয়েছে, যা দেশের রিজার্ভে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। দেশীয় বাজারে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ না দিতে এই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মজুদ গুরুত্বপূর্ণ।
সামগ্রিকভাবে, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রবাসী আয়ের ইতিবাচক ধারাবাহিকতা এবং নতুন গভর্নরের কৌশলগত পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল অবস্থানে পৌঁছাবে।