বাংলাদেশে অর্থপাচারের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি’র তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হচ্ছে। সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব, দুর্বল আইন ও আর্থিক কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে এই অর্থপাচার হচ্ছে। অর্থপাচার বন্ধে ব্যবস্থা না নিলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব আরও গুরুতর হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত শনিবার (২ নভেম্বর) ঢাকার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) কার্যালয়ে ‘পাচার হওয়া অর্থ ও তা উদ্ধারের উপায়’ শীর্ষক এক সেমিনারে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “গেল দেড় দশকে রাষ্ট্র কাঠামোর দুর্বলতা এবং প্রশাসনিক জটিলতাকে কাজে লাগিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে।” তিনি বলেন, এই অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব হলেও তা সময়সাপেক্ষ।
টিআইবি জানায়, অর্থপাচার বন্ধে বাংলাদেশ সরকারকে কড়া আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব দেশে অর্থপাচার হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আইনি চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, “যদি আমাদের দেশে রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও ব্যবসায়িক সংস্কৃতির পরিবর্তন না আনা হয়, তাহলে অর্থপাচার ও দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।”
টিআইবি’র প্রস্তাব অনুযায়ী, অর্থপাচার বন্ধে দেশের রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রতি বছর এত বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হওয়ার ফলে বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাচার হওয়া অর্থ যদি দেশের মধ্যে বিনিয়োগ করা যেত, তাহলে অনেক নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো এবং দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। কিন্তু অর্থপাচারের কারণে দেশের অর্থনীতি বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক সংকটের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
অর্থপাচার রোধ এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে তাদের সঙ্গে চুক্তি ও সমঝোতা করে এই অর্থ ফেরত আনা সম্ভব।” বিভিন্ন দেশে কার্যকরী অর্থনৈতিক আইন রয়েছে, যা বাংলাদেশকে অর্থ ফেরাতে সহায়তা করতে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব ব্যাংক, এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এর সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
অর্থপাচার রোধে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কড়া আইন ও নিয়ম থাকা সত্ত্বেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। অর্থপাচার প্রতিরোধে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দেশের বাইরের আর্থিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, অর্থপাচার বন্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, “রাজনীতি, আমলাতন্ত্র এবং ব্যবসায়ের মধ্যে অব্যাহত দুর্নীতি এবং অদক্ষতা থাকলে অর্থপাচার বন্ধ করা কঠিন।” টিআইবি’র মতে, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক সময় অর্থপাচারের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক পদক্ষেপে বাধা আসে।
অর্থপাচার রোধে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের দুর্নীতি কমাতে পারলেই অর্থপাচার রোধ করা সম্ভব হবে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি, নতুন করে অর্থপাচার বন্ধে প্রশাসনের নির্ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
:
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অর্থপাচার বন্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী এবং এতে দেশের আর্থিক খাতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু এর জন্য সরকারের সঠিক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। টিআইবি’র এই উদ্বেগ এবং পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের অর্থনীতি অনেকটাই এগিয়ে যাবে এবং অর্থপাচারের প্রবণতা কমানো সম্ভব হবে।
:
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। টিআইবি মনে করে অর্থপাচার বন্ধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। এই প্রতিবেদনে পাচার রোধের করণীয় ও প্রস্তাবনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।