অবশেষে বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশে চালু হচ্ছে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ। এ উদ্যোগ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে চলেছে, যা শুধুমাত্র যাত্রীবাহী ট্রেনের যাত্রাকে গতিময় করবে না, বরং দেশের অর্থনীতির চাকা আরও দ্রুত ঘুরাবে। বাংলাদেশ রেলওয়ের পদ্মা রেল লিঙ্ক প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেনের কথায় জানা গেছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে এ রেলসেবা চালুর ব্যাপারে সরকার আশাবাদী।
প্রাথমিকভাবে ১৫ নভেম্বর ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেন যশোর থেকে ঢাকা কমলাপুর স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসবে। এছাড়াও একই দিনে আরেকটি ট্রেন ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ কমলাপুর থেকে খুলনার উদ্দেশে রওনা দেবে। এই রেল যোগাযোগ চালু হলে যশোর থেকে ঢাকার যাত্রাপথের সময় প্রায় অর্ধেক কমে যাবে। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এ রেলপথ বিশাল প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ সরকারের রেল লিঙ্ক প্রকল্পে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর রেল সংযোগ দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং বৃহৎ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত। কমলাপুর থেকে রূপদিয়া ও সিংগিয়া স্টেশন পর্যন্ত মোট ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালক জানান, চীনের ঋণে ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি অর্থায়ন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
প্রকল্পটি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ব্রডগেজ সিঙ্গেল লাইন রেল ট্র্যাক, যা সুষ্ঠুভাবে খুলনাগামী রেললাইনকে রূপদিয়া ও সিংগিয়া স্টেশনের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছে। এর ফলে, পদ্মা সেতু দিয়ে খুলনা অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সাশ্রয়ী, দ্রুত এবং আধুনিক রেল যোগাযোগ সম্ভব হবে। নতুন এই ব্রডগেজ রেলপথ শুধুমাত্র যাত্রী সেবা নয়, পণ্য পরিবহনেও বিশাল অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বর্তমানে ঢাকা থেকে যশোর যেতে প্রায় আট ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। তবে পদ্মা সেতু হয়ে এই নতুন রেলপথ চালু হলে এই যাত্রার সময় প্রায় অর্ধেক কমে চার ঘণ্টায় দাঁড়াবে। ঢাকা-যশোর রেললাইনটি চালু হলে এ পথে দূরত্ব হবে মাত্র ২০০ কিলোমিটার, যা একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। এছাড়া এই রেলপথের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সাশ্রয়ী যোগাযোগও নিশ্চিত হবে।
ঢাকা থেকে মংলা সমুদ্রবন্দর এবং দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের সাথেও সরাসরি যোগাযোগ হবে। অর্থাৎ, ঢাকা-যশোর রেললাইনটি মূলত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে ঢাকার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করবে, যা দেশের সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। পণ্য পরিবহন এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে অনেক গুণ, যা দেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।
এই রেল যোগাযোগ চালু হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। ঢাকা থেকে যশোর হয়ে সুন্দরবন বা কক্সবাজার, কিংবা কুয়াকাটা যাওয়ার সময় কমে যাওয়ায় পর্যটকদের জন্য একটি সুবিধাজনক এবং দ্রুত ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্থানীয় পর্যায়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, গাইড সেবা, ট্রাভেল এজেন্সি এবং পরিবহন সেক্টরে নতুন কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়া যশোর ও খুলনা অঞ্চলের স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য খাতের পণ্য সরবরাহ সহজতর হবে, যা সরাসরি এই অঞ্চলের কৃষকদের আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্রুত এবং নিরাপদ রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে ঢাকা থেকে যশোর এবং খুলনা অঞ্চলে সঠিক সময়ে কৃষি ও মৎস্যজাত পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হবে, যা রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর রেলপথ চালু হলে পরিবহন খাতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। বর্তমানে সড়ক পথে যানজট ও দীর্ঘ সময়ের কারণে যাত্রীদের জন্য ভ্রমণ অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে থাকে। তবে রেল যোগাযোগ চালু হলে দ্রুত, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত হবে, যা যাত্রীদের ভ্রমণের মান উন্নত করবে।
সড়ক পথে ট্রাক ও বাসের চাপ কমবে এবং সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর সম্ভাবনাও তৈরি হবে। সরকারও সড়ক সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের উপর খরচ কমাতে পারবে। ফলে, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর রেলপথ চালুর ফলে বহুমুখী সুবিধা পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী বিশ্লেষকরা।
পদ্মা রেল লিঙ্ক প্রকল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রকল্পে ব্রডগেজ সিঙ্গেল লাইনের মাধ্যমে উন্নত এবং কার্যকর রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ডিজিটাল সিগন্যালিং, ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা যুক্ত করে রেল চলাচলের নিরাপত্তা ও গতিশীলতা আরও নিশ্চিত করা হয়েছে।
এছাড়া নতুন স্টেশনগুলোতে আধুনিক যাত্রীসেবা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ট্রেনের সময়সূচি, অবস্থান নির্ধারণ এবং টিকেট বুকিং ব্যবস্থাও ডিজিটালাইজড করা হয়েছে, যা যাত্রীদের জন্য সহজ এবং সুবিধাজনক হবে।
এই নতুন রেললাইনটি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এমন উন্নত রেল যোগাযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে সংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং গ্রামীণ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প। এতে করে পুরো দেশ জুড়ে একটি কার্যকর রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সম্ভব হবে, যা দ্রুত এবং নিরাপদ যোগাযোগের পথ তৈরি করবে।
যদিও পদ্মা রেল লিঙ্ক প্রকল্পটি দেশের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে, তবে এই প্রকল্পটি পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিশাল ব্যয়ে নির্মিত এই রেলপথটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং কার্যকরীভাবে পরিচালনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে স্টেশনগুলোর কার্যকর ব্যবস্থাপনা, ট্রেনের নিয়মিত সময়সূচি বজায় রাখা, ওভারলোডিং নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্নীতিমুক্ত পরিবহন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই প্রকল্পের সকল সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে এটি দেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং পরিবহন ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।
ঢাকা থেকে যশোরের রেল যোগাযোগ চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নবযুগের সূচনা ঘটতে যাচ্ছে। এ রেললাইনটি চালু হলে ঢাকা-যশোর পথের দূরত্ব কমবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। পর্যটন শিল্প, ব্যবসায়িক খাত, পণ্য পরিবহন এবং কর্মসংস্থানে এটি বিশেষ অবদান রাখবে।
পদ্মা সেতু হয়ে এ রেলপথ চালু হওয়ার ফলে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অভাবনীয় প্রভাব ফেলবে।