মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনার শঙ্কা দেখা দিয়েছে, ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যকার সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে। ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার ঘোষণা দিলেও, তারা একইসঙ্গে এই সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের বরাতে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল এ তথ্য প্রকাশ করেছে। এমন পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত ভারসাম্যকে নাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায়ও প্রভাব ফেলতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান তার সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশের পেছনে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি দেশটির সামরিক বাহিনীকে একাধিক প্রতিশোধমূলক পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তিনি এও সতর্ক করেছেন যে, ইরান কোনোভাবেই এই সংঘাতকে বাড়ানোর উদ্যোগ নেবে না যদি ইসরায়েল সীমিত সামরিক হামলায় থেমে থাকে।
চারজন ইরানি কর্মকর্তার বরাতে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ইরান প্রস্তুত থাকলেও তারা ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলার ধরন অনুসারে প্রতিক্রিয়া জানাবে। যদি ইসরায়েল তাদের তেল বা পারমাণবিক স্থাপনা কিংবা শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়, তবে ইরান পাল্টা আক্রমণে ১ হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। তবে, যদি ইসরায়েলের হামলা সীমিত মাত্রায় থাকে এবং সামরিক স্থাপনা কিংবা অস্ত্রের গুদামকেন্দ্রিক হয়, তবে ইরান সংঘাতকে আরও বাড়ানোর পথ থেকে সরে আসতে পারে।
ইরান বরাবরই মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বজায় রাখতে কৌশলগতভাবে এগিয়েছে। তাদের সামরিক বাহিনী, বিশেষ করে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC), গত কয়েক দশকে ইরানকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাদের হাতে থাকা উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং প্রভাবশালী সামরিক ক্ষমতা ইরানকে সম্ভাব্য যেকোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম করেছে। ইসরায়েল বা অন্য কোনো দেশ যদি ইরানের বিরুদ্ধে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ চালাতে চায়, তবে ইরানও পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে তার প্রতিরক্ষামূলক সক্ষমতা দেখাতে প্রস্তুত।
তবে ইরানের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, তারা এই সংঘাতকে বাড়ানোর ইচ্ছে রাখে না। বরং, তারা এই যুদ্ধ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইরানের কৌশল হলো, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি রাখা এবং প্রতিপক্ষকে একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়া—যাতে ইরানের সার্বভৌমত্বের প্রতি কোনো হুমকি দেখা না দেয়। ইরানের কর্তাব্যক্তিরা বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তারা সংঘাতের পথে যেতে চান না, কিন্তু তাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সামরিক এবং পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরোধিতা করে আসছে। ইসরায়েল মনে করে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। এই কারণে ইসরায়েল বিভিন্ন সময় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা বা হুমকি দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক হামলাগুলোর মাধ্যমে ইসরায়েল ইরানের সামরিক কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও ইসরায়েল সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে আক্রমণাত্মক প্রতিরক্ষার কৌশল বেশি ব্যবহার করে, কিন্তু ইরান যদি পাল্টা আক্রমণ চালায়, তাহলে ইসরায়েলও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশও এই উত্তেজনার দিকে নজর রাখছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক ও অন্যান্য দেশ এই দুই শক্তির মধ্যে সংঘাতের প্রভাব তাদের ওপর কতটা পড়বে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ হলে তা শুধু এই দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক তেল সরবরাহের উপরও এর প্রভাব পড়বে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নাজুক করে তুলতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের প্রভাব এবং ইসরায়েলের সঙ্গে তার কৌশলগত মিত্রতা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থন বরাবরই ইরানের জন্য এক ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ইরান মনে করে, ইসরায়েলের যেকোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের পেছনে মার্কিন প্রভাব থাকতে পারে। মার্কিন সরকার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে এবং ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে আসছে।
তবে ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব আরও সংযত। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায় না, কারণ তা পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক অস্থিতিশীলতার সূচনা করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা করছে, এবং এ অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার উত্তেজনা মার্কিন প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের ফলাফল শুধুমাত্র এই দুটি দেশের ওপরই প্রভাব ফেলবে না, বরং তা পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দেবে। ইরান ও ইসরায়েলের যেকোনো সামরিক সংঘাত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে এই উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে। বিশেষত, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস এবং সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াগুলোও এই যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে।
এই সংঘাতের ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও উদ্বেগ সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, ইরান ও ইসরায়েলের যেকোনো বড় ধরনের সংঘাত বিশ্ব তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাতে পারে, যা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেই সঙ্গে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের ভূমিকাও নতুন করে আলোচনায় আসবে।
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। যেকোনো সামরিক সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে একটি অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দেবে এবং এর প্রভাব বৈশ্বিকভাবে অনুভূত হবে। তবে, কূটনৈতিক উপায়ে এই সংঘাত এড়ানো সম্ভব হলে তা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।