নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। একটি পণ্যের দাম সামান্য কমলেও অন্য কয়েকটি পণ্যের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়, ফলে বাজারে ক্রেতাদের স্বস্তি মিলছে না। সর্বশেষ বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী চাল, তেল, চিনি ও পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। সরকার পণ্যের শুল্ক ও কর কমালেও তার প্রভাব এখনো বাজারে তেমনভাবে পড়েনি, ফলে প্রশ্ন উঠেছে—শুল্ক ছাড়ের সুফল ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি না।
চালের দাম বৃদ্ধি
চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত দুই-তিন বছর ধরে চালের দাম উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, এবং বর্তমানে মাঝারি ও সরু চালের দাম কেজিপ্রতি ১ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। ঢাকার কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সোমবার মাঝারি মানের ব্রি-২৮ চাল ৬১-৬২ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ছিল ৫৮-৫৯ টাকা। এছাড়া ব্রি-২৯ চালের দামও ৩ টাকা বেড়ে ৬২-৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চালের মধ্যে মিনিকেট ও নাজিরশাইলের দামও কেজিপ্রতি ১-২ টাকা বেড়েছে। ভালো মানের নাজিরশাইল চাল এখন ৮০ টাকায় বা তার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
চালের বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, ধানের সরবরাহ কম থাকায় মিল মালিকেরা দাম বাড়িয়েছেন। বর্তমানে আমন মৌসুম চললেও অসময়ের অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা চালের দাম বৃদ্ধির একটি কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমনে উৎপাদন কম হলে চালের দাম আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, সরকার সম্প্রতি চাল আমদানির শুল্ক-কর কমিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে জানানো হয়েছে, শুল্ক–কর কমানোর ফলে আমদানি পর্যায়ে চালের দাম কেজিপ্রতি ১৪ টাকা ৪০ পয়সা কমতে পারে। তবে এখনো চালের আমদানি শুরু হয়নি, ফলে শুল্ক ছাড়ের বাস্তব সুফল বাজারে দেখা যায়নি। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চালের ঘাটতি পূরণ করতে আমদানি বাড়ানো জরুরি, যেন বাজারে সরবরাহে কোনো সংকট না হয় এবং মিল মালিকরা এই সুযোগে দাম আরো বাড়িয়ে নিতে না পারেন।
তেল ও চিনির দাম বৃদ্ধি
সরকার ভোজ্যতেল ও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুল্ক-কর কমালেও বাজারে এর প্রভাব এখনো দেখা যায়নি। বরং উল্টো এ পণ্যগুলোর দাম আরও বেড়েছে। এক সপ্তাহে চিনির দাম কেজিপ্রতি ৩-৪ টাকা বেড়ে ১৩০-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্কছাড়ের চিনি বাজারে আসতে এখনো কিছুটা সময় লাগবে।
গত ১৭ অক্টোবর ভোজ্যতেলের শুল্ক কমানো হয়। তবে তেলের বাজারেও এখনো শুল্কছাড়ের প্রভাব দেখা যায়নি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) জানিয়েছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে খোলা সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দাম লিটারে ১-২ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১৫৩-১৫৬ টাকা এবং পাম তেল ১৪৮-১৫১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত তেলের দাম স্থিতিশীল থাকলেও খোলা তেলের দামের এই বৃদ্ধির কারণে ক্রেতারা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি
বাজারে পেঁয়াজের দামও হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। গত দুই দিনে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা বেড়েছে। দেশি পেঁয়াজ বর্তমানে ১২০-১৩০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ১১০-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারী হাটের আড়তদাররা জানিয়েছেন, আমদানি করা পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। ভারত থেকে আসা পেঁয়াজ পাইকারিতে ১০০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে, যার প্রভাব পড়েছে দেশি পেঁয়াজের বাজারেও।
কৃষকদের ভাষ্যমতে, বর্তমানে তাদের পেঁয়াজের মজুত শেষ হয়ে আসছে। বছরের এই সময়ে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসার কথা থাকলেও অসময়ের বন্যা ও বৃষ্টির কারণে কৃষকরা পেঁয়াজ লাগাতে দেরি করেছেন, যা পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
বাজারে মূল্যস্ফীতির প্রভাব
বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি এর চেয়ে আরো বেশি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। নতুন সরকার দাম কমানোর চেষ্টা করলেও বাজারে বিভিন্ন কারণে হঠাৎ পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অসময়ের বৃষ্টি ও বন্যাকে দাম বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে বাজার বিশ্লেষকদের মতে, সরবরাহ বাড়ানো এবং সরকারের যথাযথ নজরদারির অভাবে এই অস্থিরতা চলছে। পণ্যগুলোতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হলেও, সেই সুবিধা সাধারণ মানুষ এখনো পাচ্ছে না, যা বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কর ও শুল্ক ছাড়ের প্রভাব
সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কিছু পণ্যে শুল্ক ও কর কমিয়েছে। তবে এর বাস্তব প্রভাব কবে বাজারে দেখা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে চাল, তেল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কছাড়ের প্রভাব বাজারে পড়তে কিছুটা সময় লাগছে। তবে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিয়ে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে, নাহলে মিল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে দাম আরও বাড়িয়ে ফেলতে পারেন।
বাজার পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পণ্যের দাম কমাতে শুধু শুল্ক ও কর ছাড় দেওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে যথাযথ নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি না থাকে এবং ব্যবসায়ীরা বাড়তি দাম আদায় করতে না পারেন।
নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য চালের দাম বৃদ্ধি সব সময়ই একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে চালের বাজারে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে তেল ও চিনির বাজারে শুল্কছাড়ের প্রভাব দ্রুত কার্যকর করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা উচিত।
নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সামাল দিতে সরকার শুল্ক ও কর ছাড় দিলেও, তার বাস্তব প্রভাব এখনো বাজারে দেখা যায়নি। বরং চাল, তেল, চিনি ও পেঁয়াজের দাম বেড়ে ক্রেতাদের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, শুল্ক ছাড়ের সুফল পেতে হলে সরবরাহ বাড়াতে হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যাতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে।