সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার সীমান্তে চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতে পাচারের সময় বিজিবি ও পুলিশের যৌথ অভিযানে ৪১ হাজার ৮৭৭ কেজি বাংলাদেশি রসুন জব্দ করা হয়েছে। এ অভিযানে আটক করা হয়েছে একজন চোরাকারবারিকেও। গতকাল, ২০ অক্টোবর, ৪৮ বিজিবির অধীন দোয়ারাবাজার সীমান্তের উত্তর-কলাউড়া এলাকায় এই পণ্যগুলো জব্দ করা হয়। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল সীমান্ত অঞ্চলে চোরাচালান রোধ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বিজিবি ও পুলিশের যৌথ টাস্কফোর্সের এ অভিযানটি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্তবর্তী উত্তর-কলাউড়া এলাকায় অভিযানটি সম্পন্ন হয়, যেখানে নেতৃত্ব দেন দোয়ারাবাজার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি অধিগ্রহণ শাখা) মো. রৌশন আহমেদ। অভিযানের ফলে মোট ৪১ হাজার ৮৭৭ কেজি বাংলাদেশি রসুন এবং ১০০ কেজি সুপারি জব্দ করা হয়।
জব্দকৃত রসুনের আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ রসুন ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান জানান, এই অভিযান বিজিবির চোরাচালান বিরোধী নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ ছিল এবং সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিজিবি ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
এই অভিযানের সময় শুধু রসুনই নয়, সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরও বিভিন্ন ধরনের অবৈধ পণ্যও জব্দ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ৫৪ পিস ভারতীয় শাড়ি, ৩২১ বোতল মদ, দুটি মোটরসাইকেল এবং অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত ৮টি নৌকা। এসব পণ্যের আনুমানিক বাজার মূল্য ২ কোটি ১৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এসব পণ্য পাচারকারীরা অবৈধভাবে ভারতে পাঠানোর চেষ্টা করছিল বলে জানা গেছে।
বিজিবি জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান প্রতিরোধে নিয়মিত গোয়েন্দা তৎপরতা ও অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালানি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বিজিবির অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং যে কোনো ধরনের চোরাচালান রোধে বিজিবি সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান জানান, সিলেট ও সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় বিজিবির কার্যক্রম অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ১৩ অক্টোবরের আরেকটি অভিযানে সিলেট ও সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকা থেকে ১ হাজার ৭০০ কেজি রসুন এবং ১০০ কেজি সুপারি জব্দ করা হয়েছিল। এছাড়াও ভারত থেকে অবৈধ পথে আনা ৫ হাজার ৬০০ কেজি আপেল, ১ হাজার ৭৫০ কেজি চিনি, ২৩ বোতল মদ এবং এসব পণ্য বহনের জন্য ব্যবহৃত একটি টাটা ট্রাক এবং একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করা হয়। এই অভিযানের জব্দকৃত পণ্যের বাজারমূল্য আনুমানিক ৭৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর দীর্ঘদিন ধরেই চোরাচালানের সমস্যা প্রকট। বিশেষ করে কৃষিজাত পণ্য, শাড়ি, মাদক, ইলেকট্রনিক্স, এবং পাথর চোরাচালানের অন্যতম প্রধান সামগ্রী। চোরাচালানকারীরা সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এলাকা এবং নদীপথকে ব্যবহার করে এসব পণ্য পাচারের চেষ্টা করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চোরাচালানের পেছনে অন্যতম কারণ হলো সীমান্ত এলাকায় অবৈধ বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দ্রুত লাভের আশায় এমন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় চোরাচালানের মাধ্যমে যেসব পণ্য ভারতে পাচার হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পাট, রসুন, পাথর, এবং সুপারি। অপরদিকে, ভারত থেকে বাংলাদেশে চোরাচালান হয় মূলত মদ, চিনি, শাড়ি, এবং ফলমূল।
সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বিজিবি বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো সীমান্তে টহল জোরদার করা, স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো।
বিজিবি ও অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চোরাচালান বিরোধী অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করছে এবং সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করেছে। এর ফলে চোরাচালানি কার্যক্রম অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে বলে জানান বিজিবি কর্মকর্তারা।
তবে সীমান্তে চোরাচালান পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বিজিবির অভিযানের কারণে চোরাচালানকারীদের তৎপরতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। বিজিবি আরও জানিয়েছে যে, সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং চোরাচালান রোধে প্রযুক্তিগত সহায়তা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যার মধ্যে ড্রোনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জব্দকৃত রসুনসহ অন্যান্য চোরাচালানি পণ্য বিধি অনুযায়ী কাস্টমস বিভাগে হস্তান্তর করা হবে। এর মাধ্যমে মালামালগুলোর সরকারি নিলামের ব্যবস্থা করা হবে বা বিধি অনুযায়ী অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আটক চোরাকারবারির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। চোরাচালান প্রতিরোধে সরকারের চলমান পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এই ধরনের অভিযান আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।
সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ এবং বিজিবি ও পুলিশের সমন্বিত অভিযানের ফলে সুনামগঞ্জ সীমান্তে চোরাচালানি কার্যক্রম অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। বিজিবি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান, প্রযুক্তিগত সহায়তা, এবং সীমান্ত এলাকায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে চোরাচালান প্রতিরোধ আরও কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে।