বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত, যা দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত, সাম্প্রতিক শ্রমিক অস্থিরতার কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, গত দুই মাসে গার্মেন্টস খাতে প্রায় ৩০০-৪০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, শ্রমিক অসন্তোষ এবং শিল্পাঞ্চলের অস্থিরতার কারণে এই ক্ষতি আরও বাড়তে পারে।
১৯ অক্টোবর ২০২৪, শনিবার বিজিএমইএ-এর উত্তরা কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার রফিকুল ইসলাম এসব তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, শিল্পখাতের অবস্থা ভালো নয় এবং আন্তর্জাতিক পোশাক আমদানির প্রবণতাও হ্রাস পাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গার্মেন্টস শিল্পে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছে।
বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২০২৪ সালের জানুয়ারি-আগস্ট সময়কালে পোশাক আমদানি সামান্য বেড়েছে (১.৫ শতাংশ), কিন্তু বাংলাদেশ থেকে রফতানি কমেছে ৩.৮ শতাংশ। বিপরীতে, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ও কম্বোডিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। একইভাবে, ইউরোপেও পোশাক আমদানি সামান্য বেড়েছে (৩.৩ শতাংশ), কিন্তু বাংলাদেশের রফতানি বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২.৮ শতাংশ। এর ফলে, চীন, ভারত, কম্বোডিয়া, ও ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশ রফতানি প্রবৃদ্ধিতে পিছিয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অসন্তোষের ফলে গার্মেন্টস শিল্পে ব্যাপকভাবে উৎপাদন এবং রফতানি ব্যাহত হয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি জানান, শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই গার্মেন্টস খাতে ২৫০-৩০০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি ও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি হলে গার্মেন্টস খাতে আরও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
রফিকুল ইসলাম বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যেই নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হলো, এলডিসি উত্তরণের পর নগদ সহায়তার হার কমিয়ে আনা। এটি শিল্পে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি এবং বিপর্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, অনেক মধ্যম আয়ের দেশ তাদের শিল্পের জন্য নামে-বেনামে প্রণোদনা দিয়ে আসছে, যা বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধার কারণ হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে রফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেন, তৈরি পোশাক খাতে অনেক উদ্যোক্তা প্রতিকূলতার মুখে ব্যবসা ধরে রাখতে পারছেন না। এজন্য বিজিএমইএ দীর্ঘদিন ধরে একটি নিরাপদ এক্সিট পলিসির দাবি জানিয়ে আসছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে ব্যবসা থেকে সুষ্ঠুভাবে প্রস্থান করতে পারবেন। তিনি সরকারের কাছে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
গার্মেন্টস খাতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি ৫.৩৪ শতাংশ হয়েছে, যা ভিয়েতনাম (১৫.৫৭ শতাংশ) এবং ভারতের (১৩.৪৫ শতাংশ) তুলনায় অনেক কম। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে পিছিয়ে পড়ছে এবং অনেক রফতানি আদেশ এসব দেশে শিফট হয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তবে গার্মেন্টস খাত আরও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে দাবি করেন খন্দকার রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, যারা গার্মেন্টস শিল্প এবং দেশের অর্থনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনা উচিত। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, শিল্পখাতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বজায় রাখতে শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে সমন্বয় এবং সহযোগিতা অপরিহার্য।
বিজিএমইএ সভাপতি শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব পোষণ করে জানান, তাদের ১৮ দফা দাবি ইতোমধ্যে মেনে নেওয়া হয়েছে। তবে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে যদি আবারও কোনো অস্থিরতা বা নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়, তাহলে তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবার ওপর বর্তাবে বলে সতর্কবার্তা দেন।
সংবাদ সম্মেলনে রফিকুল ইসলাম বলেন, পোশাক খাতের অগ্রগতির জন্য প্রণোদনা পুনর্বহাল এবং উৎপাদন স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। গার্মেন্টস খাত দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ফলে, এর উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য সকল পক্ষের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতার প্রয়োজন।
গার্মেন্টস খাতের এই পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য। তবে শ্রমিক-মালিক উভয় পক্ষের মধ্যে যথাযথ বোঝাপড়া এবং সহযোগিতাই কেবল এই শিল্পকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।