বাংলাদেশের রাজনীতিতে অগ্নিকন্যা হিসেবে পরিচিত মতিয়া চৌধুরী আর নেই। বুধবার (১৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ৮২ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন মতিয়া চৌধুরী, যা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জাতীয় সংসদের সাবেক উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্যের মৃত্যুর সংবাদে শোকের ছায়া নেমে এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
এভার কেয়ার হাসপাতালের মেডিক্যাল সার্ভিসেসের পরিচালক ডা. আরিফ মাহমুদ নিশ্চিত করেছেন যে, বুধবার সকালে মতিয়া চৌধুরী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরিবার ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বার্ধক্যজনিত রোগসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক মহলে শোকপ্রকাশ করা হয়েছে।
১৯৪২ সালের ৩০ জুন পিরোজপুর জেলার এক সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মতিয়া চৌধুরী। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সাহসী এবং সংগ্রামী মানসিকতার। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। ছাত্রাবস্থায়ই মতিয়া চৌধুরীর মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি এবং পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে চারবার কারাবরণ করেন তিনি।
মতিয়া চৌধুরীর সাহসী ভূমিকার জন্য তাকে ‘অগ্নিকন্যা’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬০-এর দশকে ছাত্র আন্দোলন ও রাজনীতিতে তিনি যে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা আজও স্মরণীয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তার অবদান ছিল অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং দলটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন।
মতিয়া চৌধুরী শেরপুর-২ আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি সংসদ উপনেতার দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে তিনি দেশের কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। তার সময়কালে কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রণোদনা ও উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল।
মতিয়া চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল। সামরিক শাসনের সময়ও তিনি বারবার কারাবরণ করেন এবং সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। রাজনীতিতে তার এই অটল সংগ্রামী মনোভাব তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। তার সাহসী নেতৃত্ব ও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল তাকে দলের অভ্যন্তরে এবং বাহিরে সমানভাবে প্রশংসিত করেছিল।
মতিয়া চৌধুরী ছিলেন একজন নিঃসন্তান নারী। তবে তার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শৃঙ্খলাপূর্ণ ও সাদাসিধে। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করতেও ভালোবাসতেন। তবে তার জীবন ছিল সংগ্রামের পথে নিবেদিত। দলের জন্য, দেশের জন্য এবং মানুষের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য অধ্যায়ের অবসান হলো। তিনি যে সংগ্রামী মনোভাব ও সাহসিকতার জন্য খ্যাত ছিলেন, তা নতুন প্রজন্মের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। তার অবদান শুধু আওয়ামী লীগেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে কৃষি উন্নয়নে তার উদ্যোগ এবং ভূমিকা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোয় বিশাল পরিবর্তন এনেছিল।
মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুর খবরে বাংলাদেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তার মরদেহ শেরপুরে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হবে বলে পরিবার থেকে জানানো হয়েছে।
মতিয়া চৌধুরী আজ নেই, কিন্তু তার সংগ্রামী ও ত্যাগের ইতিহাস বেঁচে থাকবে। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং বিশেষ করে নারীদের জন্য তিনি এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।