পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর ক্ষোভ ঝাড়তেন প্রায়ই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে ‘সুদখোর’ বলে ব্যঙ্গ করতেন। অথচ সেই শেখ হাসিনাই গত ১৫ বছরে ব্যাংক সুদ থেকে আয় করেছেন লাখ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর ধরে দেশের রাজনীতিতে এবং অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলেছেন, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা-সমালোচনা চলে আসছে। তাঁর রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হলো, যা হলফনামার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে।
শেখ হাসিনা চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ ও ২০২৩ সালে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় ব্যাংক সুদ ও সঞ্চয়পত্র থেকে আয় দেখিয়েছেন। ২০০৮ সালে তিনি দেখান, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক আমানত থেকে তার বার্ষিক আয় ছিল ২০ লাখ ৭৯ হাজার ৬৭ টাকা। ২০১৩ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ লাখ ৪৭ হাজার ১৮৫ টাকায়। ২০১৮ সালে একই উৎস থেকে আয় ছিল ১২ লাখ টাকা, আর ২০২৩ সালে এটি ২৫ লাখ টাকা এবং ব্যাংক সুদের মাধ্যমে ৩২ লাখ ২৫ হাজার ৩৪৬ টাকায় পৌঁছে।
তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে: শেখ হাসিনা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন, তা কীভাবে সম্ভব হলো? তার হলফনামায় সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি যে, তাঁর আমানত কোথায় গচ্ছিত ছিল এবং এই আয় আসলে কোন উৎস থেকে আসছে।
শেখ হাসিনার মোট আয় ২০০৮ সালে ছিল ২৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭ টাকা, যা ২০১৩ সালে বেড়ে ৭০ লাখ ১৪ হাজার ১০ টাকায় পৌঁছে। ২০১৮ সালে আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৩৪ টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে তাঁর বার্ষিক আয় দাঁড়ায় ১ কোটি ৬ লাখ ৯ হাজার ৩৪৬ টাকা। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে তিনি কোনো ভাড়ার আয় দেখাননি, যা তাঁর আয়ের উৎসের বৈচিত্র্য নির্দেশ করে।
শেখ হাসিনার ব্যাংক স্থিতি ২০০৮ সালে ছিল ৩ কোটি ১৮ লাখ ৮৪ হাজার ৯০৪ টাকা, যা ২০১৩ সালে কমে ১ কোটি ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮৩৫ টাকায় পৌঁছায়। ২০১৮ সালে আবারো এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৭ কোটি ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৩০৩ টাকায়, কিন্তু ২০২৩ সালে এটি আবার কমে ২ কোটি ৩৮ লাখ ৯৮ হাজার ৬০৭ টাকায় নেমে আসে।
শেখ হাসিনার কৃষি খাত থেকে আয়ও বিভিন্ন সময়ে উত্থান-পতনের শিকার হয়েছে। ২০০৮ সালে কৃষি থেকে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল সাড়ে ৪ লাখ টাকা, যা ২০১৩ সালে কমে ৭৫ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে কৃষি খাত থেকে আয় ৩ লাখ টাকা হলেও ২০২৩ সালে এটি বেড়ে ৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকায় পৌঁছেছে।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার হাতে নগদ অর্থ ছিল দেড় লাখ টাকা, যা ২০১৩ সালে ৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকায় পৌঁছায়। কিন্তু ২০১৮ সালে এই পরিমাণ কমে ৮৪ হাজার ৫৭৫ টাকায় এবং ২০২৩ সালে মাত্র সাড়ে ২৮ হাজার টাকায় নেমে আসে।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা কোনো স্বর্ণ বা অলংকার কেনেননি। তাঁর হলফনামায় দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে মূল্যবান ধাতু ও পাথরের অলংকারের মূল্য ছিল ১৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এছাড়া, তিনি কোনো আসবাবপত্রও কেনেননি, প্রতি বছর তাঁর আসবাবপত্রের মূল্য ছিল ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
শেখ হাসিনা তাঁর ১৫ বছরের শাসনকালে কোনো ব্যক্তিগত ঋণ নেননি। কিন্তু রাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বেড়ে সাড়ে ৬ গুণ হয়েছে। ২০০৯ সালে যখন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন দেশের ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে।
শেখ হাসিনার মোট স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ২০০৮ সালে ছিল ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৩ টাকা। ২০১৩ সালে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৫০ টাকায়। ২০১৮ সালে সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে ৭ কোটি ৬১ লাখ ৯ হাজার ৭৮৭ টাকা হলেও ২০২৪ সালে এটি কমিয়ে ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৭১ হাজার ১০৭ টাকায় দেখানো হয়েছে।
শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে পূর্বাচল প্রকল্পে ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন, যা রাজউক আইন ভঙ্গ করে হয়েছে। ২০২২ সালের ৩ আগস্ট তিনি নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে জমি বরাদ্দ নেন, কিন্তু পরবর্তীতে হলফনামায় শুধুমাত্র তাঁর নামে বরাদ্দের কথা উল্লেখ করা হয়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট ১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১১টি মামলা ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের। তবে ২০১০ সালে হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চ শেখ হাসিনার ৯টি মামলা বাতিল করেন।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের রাজনৈতিক জীবন এবং আর্থিক অবস্থান নিয়ে হলফনামার বিশ্লেষণ থেকে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতির দিক সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করছে। তাঁর অর্থনৈতিক উত্থান, ব্যাংক সুদের উপর নির্ভরতা, রাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিগত সম্পদের স্বল্পতা বিশেষভাবে নজর কাড়ছে। আগামী দিনের রাজনীতিতে এসব তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
এই প্রতিবেদনটি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং শেখ হাসিনার রাজনীতি সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেবে, যা পাঠকদের জন্য তথ্যবহুল এবং চিন্তার খোরাক হিসেবে কাজ করবে।