লেবাননের ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। রোববার (১৩ অক্টোবর) মধ্যরাতে দেশটির কেফার তিবনিত গ্রামে অবস্থিত প্রায় ১০০ বছর পুরোনো মসজিদটি লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়। এই মসজিদটি ছিল লেবাননের স্থানীয় জনগণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
লেবাননের স্থানীয় বার্তাসংস্থা জানায়, স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে ইসরায়েলি শত্রুবাহিনীর যুদ্ধবিমান গ্রামটির পুরোনো মসজিদে বোমা বর্ষণ করে। হামলার ফলে মসজিদটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। গ্রামটির মেয়র ফুয়াদ ইয়াসিন বলেন, “আমাদের গ্রামের প্রিয় স্থাপনাটি আমরা হারালাম। মসজিদটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এর পাশের চত্বরে আমাদের পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই জড়ো হতেন। এটি আমাদের ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।”
মসজিদটি কমপক্ষে ১০০ বছরের পুরোনো ছিল এবং এটি এলাকার মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক আড্ডা, সবকিছুর জন্যই এটি ছিল গ্রামবাসীর প্রিয় স্থান।
গত এক বছর ধরে ইসরায়েল ও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর মধ্যে সীমান্তে নিয়মিত সংঘর্ষ চলছিল। তবে সেপ্টেম্বর মাসে সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই দুই পক্ষের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরায়েল নিয়মিতভাবে লেবাননের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাচ্ছে, যার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে জনবসতি, অবকাঠামো এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলোও।
এই মসজিদে হামলাটি ইসরায়েলের চলমান আক্রমণের ধারাবাহিকতা বলেই মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা লেবাননের ঐতিহ্যবাহী এবং সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলোকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই হামলা শুধুমাত্র ধর্মীয় স্থাপনাকে ধ্বংস করেনি, এটি লেবাননের জনগণের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেও আঘাত করেছে।
ইসরায়েলের হামলার পর হিজবুল্লাহ জানিয়েছে যে, তারা তাদের হামলার মাত্রা আরও বাড়াবে। হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা ইতোমধ্যে ইসরায়েলের বিভিন্ন নতুন বসতিতে রকেট হামলা চালিয়েছে, যা সীমান্ত থেকে অনেক ভেতরে অবস্থিত। এই পাল্টা আক্রমণ ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লেবাননের প্রতিরোধের একটি প্রতীক হিসেবে কাজ করছে।
হিজবুল্লাহর দাবি অনুযায়ী, তারা ইসরায়েলের সামরিক অবস্থানের পাশাপাশি বেসামরিক অবকাঠামোতেও আঘাত হানবে, যতক্ষণ না ইসরায়েল তাদের আক্রমণ বন্ধ করে। সংঘাতের এই পর্যায়ে উভয় পক্ষই বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, কিন্তু কোনো পক্ষই পিছু হটতে রাজি নয়।
ইসরায়েলের চলমান হামলায় লেবাননে ইতোমধ্যে অন্তত দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যা এই অঞ্চলের মানবিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসরায়েলের বিমান হামলার পর পুরো দেশজুড়ে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষদের জন্য খাদ্য, চিকিৎসা এবং আশ্রয় প্রদান এখন লেবাননের সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে লেবাননের ভঙ্গুর অর্থনীতি আরও সংকটে পড়েছে।
কেফার তিবনিত গ্রামের মসজিদটি ছিল শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি ছিল ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক এক প্রতীক। মসজিদটির ধ্বংসের ফলে কেবলমাত্র ঐতিহ্যই হারিয়ে যায়নি, বরং স্থানীয় জনগণের জন্য এটি এক গভীর মানসিক আঘাত হিসেবে কাজ করেছে।
মসজিদটি একটি সভ্যতার স্মারক ছিল, যা স্থানীয় মানুষদের জন্য প্রেরণা এবং একতাবদ্ধতার প্রতীক হিসেবে কাজ করতো। এটির ধ্বংস লেবাননের ইতিহাসের একটি অধ্যায় মুছে ফেলার শামিল।
ইসরায়েলের এই হামলা এবং লেবাননের ঐতিহ্যবাহী মসজিদের ধ্বংসের ঘটনাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তুলেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ধরনের আক্রমণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে অভিহিত করছে এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন শাখা থেকেও এই হামলার নিন্দা করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
লেবাননের কেফার তিবনিত গ্রামের ১০০ বছরের পুরোনো মসজিদে ইসরায়েলের এই বর্বর হামলা শুধু একটি স্থাপত্যকে ধ্বংস করেনি, এটি একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতির একটি অংশকেও বিলীন করেছে। হামলার ফলে শুধু লেবানন নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ এবং ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণের ফলে সংঘাতের গতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।