নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ‘দাঙ্গার উসকানি’ দেয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী খালাস পেয়েছেন। বুধবার (৯ অক্টোবর) সকালে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুবুল হকের আদালত এই আদেশ দেন। আদালত মামলার বাদীর অনুপস্থিতি এবং পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে আসামিদের খালাস দেন।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী, দিয়া খানম মিম এবং আব্দুল করিম রাজীব নিহত হন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনটি দ্রুত ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে সারা দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী মিছিল ও সড়ক অবরোধের মাধ্যমে আন্দোলনের রূপ নেয়।
২০১৮ সালের ৬ আগস্ট জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এবি সিদ্দিকী নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকার মহানগর হাকিম এইচ এম তোয়াহার আদালতে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা শিক্ষার্থীদের এ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কুমিল্লায় অবস্থানরত নওমী নামে এক কর্মীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের মাধ্যমে ঢাকায় লোকজন নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই অডিও ক্লিপটি পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এছাড়া, অভিযোগ করা হয় যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও রুহুল কবির রিজভীর নির্দেশে ছাত্রদলের কর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং আন্দোলনকে সহিংস করে তোলে। তাদের নির্দেশেই উত্তরায় এনা পরিবহনের দুটি বাসে অগ্নিসংযোগ, জিগাতলায় আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা এবং মিরপুরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করা হয়।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে করা এ মামলাটি বেশ কয়েকটি শুনানি শেষে শেষ হয়। বুধবার আদালত মামলার বাদীর অনুপস্থিতি এবং যথাযথ প্রমাণের অভাবে বিএনপি নেতাদের খালাসের আদেশ দেন। বিএনপির সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন মেসবাহ আদালতের এই আদেশের পর বলেন, “মামলাটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। শুধুমাত্র বিএনপি নেতাদের হয়রানি করার জন্যই এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।”
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আন্দোলনের মূল দাবি ছিল সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে না চালানো, চালকদের জন্য কঠোর শাস্তি এবং ছাত্রদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন সারা দেশে ব্যাপক সমর্থন পায় এবং দেশের বিভিন্ন শহরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যার মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস ছিল। তবে আন্দোলনকারীরা দাবি করে যে সরকার এসব প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এছাড়া, আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ এবং সহিংসতার ঘটনায় দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে।
মামলার একটি প্রধান অংশ ছিল আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কথিত অডিও ক্লিপ, যেখানে তিনি কুমিল্লার নওমী নামে এক কর্মীর সঙ্গে আন্দোলনে ছাত্রদলের কর্মীদের অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন বলে অভিযোগ করা হয়। এই অডিও ক্লিপটি আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই ক্লিপের ভিত্তিতেই মামলার অভিযোগগুলো মূলত গঠিত হয়েছিল। বিএনপি পক্ষ থেকে এই ক্লিপকে ভুয়া এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করা হয়।
বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে করা এই মামলাটি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিল। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ধরনের মামলাগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়। বিএনপি বরাবরই অভিযোগ করে আসছে যে তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা রাজনৈতিক হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এই মামলাটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বিএনপির আইনজীবীরা শুরু থেকেই এ মামলাকে ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে দাবি করে আসছিলেন।