বাংলাদেশে যোগাযোগ খাতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল “আখাউড়া-সিলেট রেলপথের মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর” প্রকল্প। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে এটি প্রথম অনুমোদিত হলেও পরে অর্থায়ন নিয়ে চীন ও ভারতের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। তবে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আবারও এই প্রকল্পের কার্যকারিতা এবং বাতিলের পেছনের কারণগুলো নিয়ে তদন্ত করছে।
২০১৬ সালে চীনা অর্থায়নে “বাংলাদেশ রেলওয়ের আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে উন্নীতকরণ” প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এটি বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক (জিটুজি) একটি প্রকল্প ছিল। প্রকল্পটির অর্থায়নের জন্য চীনা সরকারের পক্ষ থেকে ৬৬ দশমিক ১৬ শতাংশ অর্থের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনীয় সকল প্রশাসনিক কাজ শেষ করে ২০১৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনও পাওয়া যায়।
তবে, প্রকল্পের খরচ বেশি মনে হওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যয় কমানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশন (সিআরবিসি)’ খরচ কমানোর বিষয়ে আপত্তি তোলে। এ নিয়ে দরকষাকষি চালাতে গিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ব্যর্থ হয় এবং চীনা প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। পরবর্তীতে ভারতের সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হলেও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকনের সঙ্গে অর্থায়নের শর্তে বাংলাদেশ সরকার একমত হতে না পারায় সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত এই সমস্যাগুলো নিয়েই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করছেন। সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রকল্পটির বাতিলের কারণ, ব্যয়বহুলতা, এবং ভবিষ্যতে তা পুনঃবাস্তবায়ন করা যেতে পারে কিনা সে বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, কেন এই প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পাওয়ার পরেও বাতিল করা হলো তা জানার জন্য অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। যদিও এই মুহূর্তে প্রকল্পটি পুনরায় চালু করার কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তবে বিষয়টি আরও আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা থেকে সিলেটের যোগাযোগকে আরও সহজ করতে আখাউড়া-সিলেট রেল প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আখাউড়া-কুলাউড়া-ছাতক রেলপথটি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটারগেজ রেলপথ, যা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া জংশন থেকে হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেটের সঙ্গে সুনামগঞ্জের ছাতক বাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি আপগ্রেড করা হলে সিলেটের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ আরও সহজতর ও দ্রুততর হয়ে উঠত। একই সঙ্গে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এটি ভূমিকা রাখতে পারত।
এই প্রকল্পের আওতায় আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ২৩৯ দশমিক ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে গতিশীলতা বৃদ্ধি পেত, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারত। তবে, সঠিক অর্থায়নের অভাবে এবং খরচের পরিমাণ অত্যাধিক হওয়ায় এই প্রকল্পটি থমকে যায়।
আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের সঙ্গে সমঝোতার ব্যর্থতা এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দরপত্রের পর দর পুনর্নির্ধারণ নিয়ে মতবিরোধ, এবং ভারতের অর্থায়নের শর্তে সম্মত না হওয়া প্রকল্পটিকে সংকটে ফেলে দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পটির ব্যয় ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা গ্রহণ করেনি চীনা প্রতিষ্ঠান। খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে গঠিত কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও কোনও সমাধান বের করা যায়নি।
তবে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নতুন করে আলোচনার মাধ্যমে প্রকল্পটি পুনরায় বাস্তবায়নের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে। বিশেষ করে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এবং জনগণের জন্য প্রকল্পটি জনকল্যাণকর প্রমাণিত হলে, সরকার এর অর্থায়ন ও অন্যান্য জটিলতা কাটিয়ে উঠে নতুন উদ্যোগ নিতে পারে।
আখাউড়া-সিলেট রেলপথের আপগ্রেডেশন প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় ব্যয় সংশোধন করে সমঝোতা করতে হবে। সরকারি পর্যায়ে প্রকল্পের গুরুত্ব এবং স্থানীয় জনগণের সুবিধার দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আরও আলোচনা ও মূল্যায়নের পর প্রকল্পটি পুনরায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।