সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষানীতি এবং পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা এবং বিতর্ক শুরু হয়। এরই মধ্যে, পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জনের জন্য গঠিত সব কমিটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। আদেশে জানানো হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক প্রণীত ও মুদ্রিত সকল পাঠ্যপুস্তকের সংশোধন ও পরিমার্জন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন এবং সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত সমন্বয় কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক অফিস আদেশে ১০ সদস্যের একটি সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম এবং সদস্যসচিব ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মো. ইয়ানুর রহমান। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা গবেষকরা কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। কমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত এবং মুদ্রিত সকল পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয় সংশোধন এবং সমন্বয় করা।
গঠিত কমিটির সদস্যদের মধ্যে শিক্ষা গবেষক রাখাল রাহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাসুদ আখতার খান ছিলেন। এছাড়া এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান এবং সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী ও প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের অধ্যাপক এ এফ এম সারোয়ার জাহান কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তাদের ভূমিকা ছিল শিক্ষা কারিকুলামে বৈজ্ঞানিক, সামাজিক এবং ভাষাগত দিকগুলো আরও সুসংহত করা।
কমিটি গঠনের পরেই পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটিতে আলেমদের অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠে আসে। বিভিন্ন ধর্মীয় মহল থেকে বলা হয়, পাঠ্যপুস্তকের ধর্মীয় বিষয়বস্তু এবং ইসলামিক শিক্ষা সংশোধন ও পরিমার্জনে ইসলামিক স্কলারদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দাবি ছিল, পাঠ্যপুস্তকে ধর্মীয় বিষয়াদির ক্ষেত্রে বিশেষত ইসলামিক মূল্যবোধ সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য কমিটিতে কমপক্ষে দুইজন আলেমকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তবে এই দাবি আমলে নেওয়ার আগেই কমিটি বাতিল করা হয়, যা আরও বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে কমিটি বাতিলের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে শিক্ষানীতির সংশোধন নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক এবং পাঠ্যপুস্তকে থাকা বিষয়বস্তু নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে সামাজিক ও ধর্মীয় দিক নিয়ে সমালোচনা এবং পাঠ্যপুস্তক সংশোধনে আলেমদের ভূমিকা নিয়ে যে মতভেদ তৈরি হয়েছে, তা এই বাতিলের পেছনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই কমিটি বাতিলের সিদ্ধান্ত শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। পাঠ্যপুস্তক সংশোধন নিয়ে চলমান বিতর্ক এবং সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর মতামত একদিকে শিক্ষানীতি সংশোধনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত করতে পারে, অন্যদিকে শিক্ষাবিদদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করতে পারে।
শিক্ষানীতির যে নতুন দিক উন্মোচিত হওয়ার পথে ছিল, তা এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। কমিটির বাতিলের ফলে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের মানের উন্নয়ন এবং কারিকুলামের পরিবর্তন সংক্রান্ত কার্যক্রমে বিলম্ব হতে পারে, যা জাতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। একইসাথে এই বাতিলের ফলে নতুন করে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে নতুন কোনো কমিটি গঠনের ঘোষণা এখনও আসেনি। তবে বিভিন্ন মহলের দাবি অনুযায়ী, একটি আরও সমন্বিত এবং সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হতে পারে, যেখানে ধর্মীয় এবং আধুনিক শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় আনার চেষ্টা করা হবে। শিক্ষাক্রমের উন্নয়ন এবং পাঠ্যপুস্তকের মানোন্নয়নে আরও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন স্পষ্ট।
শিক্ষা খাতে সংশোধন ও পরিবর্তন অবশ্যই একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং শিক্ষানীতির গুণগত মান উন্নয়নে সরকারকে এই ক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হতে হবে।