বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফিলিস্তিনের বর্তমান বাস্তবতাকে কেবল আরব কিংবা মুসলিম বিশ্বের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়কে ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি অবিচার ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এসব কথা বলেন।
ড. ইউনূস তার ভাষণে বলেন, “বিশ্বের মানবাধিকারের প্রতিটি সংগঠন এবং বিবেকবান মানুষ ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি যে সহানুভূতি দেখিয়েছে, তা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যা বন্ধ হচ্ছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান পরিস্থিতি শুধুমাত্র আরব বা মুসলিম জনগণের উদ্বেগের বিষয় নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির জন্যই গভীর উদ্বেগের বিষয়। প্রতিটি ফিলিস্তিনি মানুষের জীবন অমূল্য এবং তাদের এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।”
ড. ইউনূস আরও বলেন, “ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, তার জন্য অপরাধীদের অবশ্যই দায়বদ্ধ করতে হবে। বিশ্ববাসী এখনই একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে কার্যকর উদ্যোগ নিলে এই মানবিক সংকটের অবসান ঘটতে পারে। নারী ও শিশুদের প্রতি প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা এবং নির্যাতন চলছে, তা বন্ধ করার এখনই সময়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমরা অবিলম্বে পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছি।”
ফিলিস্তিনের সংকটের সমাধানে ড. ইউনূস দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই একমাত্র উপায় যা মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই এগিয়ে এসে এই সমাধান বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিতে হবে। দীর্ঘদিনের এই সংকটের অবসান ঘটাতে এবং ফিলিস্তিনিদের মৌলিক মানবাধিকার ফিরিয়ে দিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে।”
ফিলিস্তিন ইস্যুর পাশাপাশি ড. ইউনূস তার বক্তব্যে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, “আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনে চলমান এই যুদ্ধ বহু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের জনগণ কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এর প্রভাব সমগ্র বিশ্বের ওপর পড়ছে, এমনকি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। আমরা উভয় পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন সংলাপে বসে তাদের বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করে এবং যুদ্ধের অবসান ঘটায়।”
ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, “বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা, জ্বালানি, এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, যা বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলছে।”
ড. ইউনূস আরও বলেন, “বাংলাদেশও এই যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং খাদ্য সংকটের কারণে আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন করছি, তারা যেন যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে স্থিতিশীলতার পথে ফিরে আসে।”
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ আহ্বান। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, “ফিলিস্তিনের সংকট মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। বিশ্ববাসীকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই অবিচার বন্ধ হয়।”
তিনি বলেন, “যুদ্ধ কখনও সমস্যার সমাধান আনতে পারে না। এটি কেবল মানুষের জীবন ধ্বংস করে এবং বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা বাড়ায়। বর্তমান সংকটগুলোকে সমাধান করার জন্য শান্তি এবং সংলাপই একমাত্র কার্যকর উপায় হতে পারে।”
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এই অধিবেশনে অন্যান্য নেতারাও ফিলিস্তিন সংকট ও বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যান্য মানবিক সংকট নিয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেকেই ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তাত্ক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ফিলিস্তিন সমস্যার প্রতি ড. ইউনূসের এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলাদেশ সবসময়ই ফিলিস্তিনের জনগণের অধিকার রক্ষার পক্ষে এবং তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে। ড. ইউনূসের বক্তব্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নীতির একটি প্রতিফলন, যেখানে মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। মানবাধিকারের প্রতি তার অঙ্গীকার এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তার আহ্বান বিশ্বব্যাপী নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটি নতুন ভাবনার সূচনা করতে পারে। ফিলিস্তিনের সংকট কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি সমস্যা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এর সমাধান করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
যুদ্ধ এবং সহিংসতার মাধ্যমে নয়, কেবল সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমেই এই ধরনের সংকটের সমাধান সম্ভব। ড. ইউনূসের বক্তব্যে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো জায়গা নেই এবং প্রতিটি মানুষের জীবন অমূল্য। ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়াই এখন সময়ের দাবি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ প্রয়োজন
ড. ইউনূসের এই বক্তব্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ আহ্বান। তিনি বলেন, “আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না। ফিলিস্তিনিদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে এবং তাদের প্রতি এই নির্যাতন বন্ধ করতে বিশ্ব নেতাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকারই মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র উপায়।”
জাতিসংঘের এই সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ড. ইউনূসের বক্তব্য অনেকের মধ্যে সাড়া ফেলেছে এবং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংস্থাগুলো তার এই বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে।
ড. ইউনূসের মতে, “বিশ্ববাসীকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি আজ ব্যবস্থা না নিই, তাহলে মানবতার এই বিপর্যয় আরও গভীর হবে এবং এর পরিণতি আমাদের সবার জন্যই ভয়াবহ হতে পারে। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হলে, এটি শুধু মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা বৃদ্ধি করবে না, বরং বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতাও বাড়িয়ে তুলবে।”
ফিলিস্তিন ইস্যুতে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আহ্বান
ড. ইউনূসের মতে, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই একমাত্র উপায়। তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং তাদের মৌলিক মানবাধিকারের স্বীকৃতি দিতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই সমাধান বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া।”
তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘদিনের এই সংকটের সমাধান কেবল আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের মধ্যে সমঝোতা ও সংলাপ স্থাপন করে তাদের মধ্যে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে।”